Hazrat Umar (ra.): Biography

Islamic Women

শনিবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৩

আল্লামা হযরত মাওলানা শাহ্ ছুফী নেছারুদ্দীন আহমদ (রহঃ) এর জীবনী

আল্লামা হযরত মাওলানা শাহ্ ছুফী নেছারুদ্দীন আহমদ (রহঃ) এর জীবনী

 



১৭৫৭ খৃষ্টাব্দে পলাশীর আম্র কাননের যুদ্ধে বাংলা বিষয় উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলার পতনের সাথে সাথেই শুরুহয় এদেশের ইসলামী তাহজীব, তমাদ্দুন ও আদর্শের অধঃপতনবিশেষ করে এই উপমহাদেশের মুসলমানগণ বর্ণনাতীত লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার শিকার হইতে লাগিলক্রমে ক্রমে অবস্থা এমন হইল যে মাত্র এক শতাব্দীর মধ্যে মুসলমানগণ তাহাদের স্বকীয় কৃষ্টি ও সভ্যতা প্রায় ভুলিয়া গিয়া নিপতিত হইল অধঃপতনের গভীর অন্ধকারেজ্ঞানের অভাবে নিজ তাহজীব তামাদ্দুন বিবর্জিত হয়ে মুসলমানগণ বরণ করে নিয়াছিল বিধর্মীদের আচার ব্যবহার ও তাহাদের চাল-চলন, পোষাক-পরিচ্ছদবিজারতীয় অনুকরণে তাহারা নামের পূর্বে শ্রীব্যবহার করিত, লুংগী পাজামার পরিবর্তে ধূতিপরিধান করিতমাথায় টুপী না পরিয়া টিকিরাখিত, এমনকি কোন কোন মুসলিম মহিলা সিথিতে সিঁদুর পর্যন্ত ব্যবহার করিতপূজা পার্বনে মুসলমানদের অবাধে অংশগ্রহণ, দেব-দেবীর নামে মান্নত ইত্যাদিবহু ইছলাম গর্হিত কাজ ও বিশ্বাস বাংলার ঘরে ঘরে সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় ছড়িয়ে পড়েছিল

জন্মকাল ও স্থান

সামাজিক এই অবক্ষয়ের সময় জাতিকে সটিক পথের দিশা দিবার জন্য অভিভক্ত বাংলার অন্তর্গত তৎকালীন বরিশাল বা বাখেরগঞ্জ জিলাধীন (বর্তমানে পিরোজপুর জিলাধীন) ছারছীনা গ্রামে জন্ম নিলেন মর্দে মুজাহিদ, যুগশ্রেষ্ঠ ওলিয়ে কামিল, মুর্শিদে বরহক, খাঁটি নায়েবে নবী আল্লামা হযরত মাওলানা শাহ্ ছুফী নেছারুদ্দীন আহমদ (রহঃ)

তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ছারছীনা দরবার উপমহাদেশের শরীয়ত ও মারেফতের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ কেন্দ্রতিনি ইলমে শরীয়তে ছিলেন যেমন একজন অতিউঁচু স্তরের মুহাক্কিক আলেম, তেমনি ইলমে মারেফতেরও একজন অতি উচ্চ মকামের ওলিয়ে কামিলনিজের জীবনে এবং তাঁর অনুগামী ও অনুসারীদের পরিপূর্ন রূপে সুন্নাতে নববীর আমল এ এত্তেবা তথা সুন্নাত পুনরুজ্জীবন এবং সর্বক্ষেত্রে তার প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর মহান সাধনালেবাস, পোষাক, চাল-চলন, খাওয়া-দাওয়া, আমল-আখলাক, লেনদেন, মোয়ামালাত-মোয়াশারাত-এক কথায় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি কাজে সুন্নাতের পাবন্দিতে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর ও আপোসহীনফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাতে মুআক্কাদাতো বটেই, এমন কি নফল, মোস্তাহাব ও মোস্তাহসানও তরক করতেন না তিনি, এবং তার মুরীদ মোতাকেদদেরকেও এ ব্যাপারে বিশেষ তাকিদ দিতেনতিনি ছিলেন কঠোর সাধক, আবেদ, জাহেদ, কাশ্ফ ও কারামওয়ালা মহান সুফী দরবেশশিরক-বেদআত ও কুসংস্কার উচ্ছেদের এক সংগ্রামী মর্দে মুজাহিদ, এক অসাধারণ সফল সংস্কারক

এই মহান মুর্শিদ তালিম ও তরবিয়াত দিয়ে যেমন একদল খলীফা তথা দ্বীনের কামেল সেবক তৈরি করে গেছেন তেমনি দেশের বিভিন্ন স্থানে ইলমে দ্বীনের মাদ্রাসা ও ইলমে তাসাউফের অগণিত খানকা প্রতিষ্ঠা করে গেছেনমোট কথা, দেশের সর্বত্র বিশেষ করে দক্ষিণ বাংলায় তিনি দ্বীনের পুনর্জাগরণ সৃষ্টি করে গেছেন
শৈশব কাল

শৈশব কাল হইতে নেছারুদ্দীন আহমদ ছিলেন ব্যতিক্রমীখেলাধুলা হাসি-তামাসা আনন্দ ফুর্তি-করে সময় কাটানো তিনি আদৌ পছন্দ করতেন নানিজ গ্রামের পাঠশালায়ই প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেনঅল্প বয়সেই তিনি সরল, সুবোধ ও দারুন ধর্মভীরু বলিয়া পরিচিত হয়ে উঠেনলেখাপড়ায় মনোযোগী ধীর স্থির ও অধ্যাবসায় এবং ধর্মানুরাগী ছিলেনপাঠশালায় যাতায়াতের সময় অন্যান্য ছাত্ররা হিন্দুদের মন্দিরের মূর্তিবিগ্রহ দর্শন করে আনন্দ কৌতুক অনুভব করিতনেছারুদ্দীন আহমদ কখনও ঐসব আনন্দ-কৌতুকে যোগ দিতেন নাসচরাচর তিনি খেলাধূলা আনন্দ কৌতুকও করতেন না ইহাই তাঁহার শৈশব জীবনের একটি প্রধান বৈশিষ্টনেছারুদ্দীন আহমদ নিজেই উক্তি করেছেন যে, তিনি পাঠশালায় ছেলেদের সহিত খেলিতেন না
শিশুসুলভ যে সকল অভ্যাস সাধারণত: শিশুদেরমধ্যে পরিলক্ষিত হয় বালক নেছারুদ্দীন আহমদ এর জীবনে সেই গুলি ছিল প্রায়ই অনুপস্থিতশিশুকাল হইতেই নেছারুদ্দীন আহমদ ছিলেন অত্যন্ত সরল প্রকৃতির-তিনি না মিথ্যা বলিতে পারিতে, না গাছে চড়িতে জানিতেনতবে তিনি সাতার জানিতেন
বাল্য বয়সেই বিবাহ ও পিতৃবিয়োগ

নেছারুদ্দীন আহমদ এর বয়স তখন বার (১২) বৎসরে উপনীত হয়েছেপিতা হাজী সদরুদ্দীন সাহেব তখন হজ্জযাত্রার আয়োজন করলেনএকমাত্র পুত্র রাখিয়া তিনি হজ্জ যাত্রা করিতেছেনসুতরাং স্বাভাবিকভাবেই পুত্রের বিবাহের আয়োজন করিতে হইলপ্রতিবেশী এক বিশিষ্ট পরিবারের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব দলীলুদ্দীন সিকদারের কন্যা ছাহেরা খাতুনকে পুত্রবধু করে ঘরে আনেনএই ছাহেরা খাতুন ছিলেন তৎকালীন খ্যাতনামা ব্যবসায়ী ও ধনাঢ্য ওসমান বাদশার জমজ বোনপুত্রের বিবাহ কার্য সমাধা করে জনাব ছদরুদ্দীন সাহেব হজ্জ্বে চলিয়া যানখোদার মর্জি! সদরুদ্দীন সাহেব আর দেশে ফিরিলেন নাতিনি মক্কাশরিফে এন্তেকাল করলেনইন্না-লিল্লাহি-অইন্না-ইলাইহি র-জিউ
নেছারউদ্দীন আহমদ অকালে পিতৃহীন হইলেনতাঁহার দাদা মরহুম জনাব জহির উদ্দিন (রহঃ) তখন জীবিতসুতরাং নেছারুদ্দীন আহমদ পৈতৃক সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত (মাদুমুল মীরাছ) হইলেনসংসার তদ্রƒপ স্বচ্ছল ছিলনাকাজেই নানা দিক দিয়া জীবন শংকটাপন্ন হয়ে উঠিল
মায়ের প্রেরণায় শিক্ষা জীবনের শুরু

স্বামীর বিয়োগে নেছারউদ্দীন আহমদ এর মহিয়সী জননী জোহরা খাতুন সাহসে বুক বাঁধিয়া পুত্রের শিক্ষার জন্য উদ্যোগী হইলেনএখন হইতে প্রায় সোয়াশত বৎসর পূর্বে বাংলার নিভৃত পল্লী গ্রামের একটি সাধারণ পরিবারের মহিলা তাহার পিতৃহীন পুত্রকে উৎসাহ দিয়া এলেম শিক্ষার জন্য বাড়ির বাহিরে প্রেরণ করিতেছেন, এই প্রেরনা তাহার কোথা হইতে কিভাবে অর্জিত হয়েছিল জানিনা, কিন্তু একথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, এই মহিয়সী নারী সাধারণের মধ্যে মহা শিক্ষিতা, সংকীর্ণের মধ্যেবিরাট, এবং বিপদের মধ্যে কর্তব্য পরায়ণা ছিলেন
এই পিতৃহীন নেছারউদ্দীন আহমদ কে যখন আমরা দেখি যে মায়ের উৎসাহে বিদেশে এলেম শিখিতে যাইয়া পরিণামে তিনি আল্লাহর একমহান অলীয়ে কামিল এবং দেশের লক্ষ লক্ষ লোকের আদর্শ ও পথ-প্রদর্শক হয়েছিলেন, তখন সুদূর অতীতের বাগদাদ বাসিনী এক মহিয়সী জননীর কথা স্মরণ না করে পারা যায় নাতিনিও একদিন তাহার পিতৃহীন পুত্র আব্দুল কাদের জিলানীকে ইলেম শিক্ষার জন্যই বিদেশে প্রেরণ করেছিলেনসেই বালক গাউছুল আজমরূপে দুনিয়ার মুসলমানের একজন শ্রেষ্ঠ ধর্মপথ প্রদর্শক হিসাবে আজও অমর হয়ে আছেনবস্তুত: দুইটি ঘটনারমধ্যে স্থান ও সময়ের সুদীর্ঘব্যবধান সত্বেও একটি আশ্চর্য সাদৃশ্য বিদ্যমান রহিয়াছে
শিক্ষার্জনের উদ্দেশ্যে মাদারীপুর গমণ

বর্তমানে মাদারীপুর একটি জেলা হইলেও তখনকার দিনে মাদারীপুর ছিল একটি মহকুমা মাত্রগোটা বরিশাল জেলায় একটি মাদরাসা ছিলনামাদারীপুরের সন্নিকটে একটি প্রাথমিক ইসলামিয়া মাদরাসাহ ছিলমায়ের উপদেশ ও দোয়া লইয়া নেছারউদ্দীন আহমদ বাড়ী হইতে রওয়ানা হয়ে গিয়া এই মাদরাসায় ভর্তি হন এবং মনোযোগ দিয়া পড়াশুনা করিতে থাকেনএই মাদরাসায় পাঠ্যাবস্থায় মাদরাসার স্বনামধন্য ওস্তাদ মরহুম মাওলানা জনাব আলী ছাহেবের ছোহবত প্রাপ্ত হয়ে নেছারউদ্দীন আহমদ বিশেষভাবে প্রীতি হয়েছিলেনএই ওস্তদসাহেবও পীরসাহেবের উন্নত চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে তাঁহাকে অত্যন্ত আদর-যত্ন করতেনওস্তাদের একমাত্র পুত্র মৌলভী এস্কানদার আলী বি, এল, কে নেছারুদ্দীন আহমদ সহোদর ভ্রাতৃতুল্য মহব্বত করতেন

মঠবাড়িয়া অঞ্চলে পীর সাহেবের পিতার অনেক সাগরেদ ছিলনেছারুদ্দীন আহমদ লেখা পড়ার ফাঁকে সাগরেদগণের বাড়ীতে বেড়াইতে যাইতেনসেখানে তিনি মীলাদ পড়তেন, ওয়াজ করতেন, উপদেশ দিতেনপিতার সাগরেদগণ তাহাদের ওস্তাদ পুত্রকে পরম যতেœ মেহমানদারী ও আপ্যায়ণ করতেন এবং হাদিয়া বা নজরানাও দিতেনইহাতে কিছু আর্থিক সমাগম হইতএই হাদিয়া তোহ্ফার টাকা তিনি সবই নিজে খরচ করতেন না মায়ের হাতেও দিতেনএইভাবেই তিনি মাদারীপুরের পাঠ্যকাল অতিবাহিত করেন
উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে মাদারীপুর হইতে ঢাকায় গমন

মাদারীপুর থেমে দাখিল (এস.এস.সি) পাশ করে নেছারউদ্দীন আহমদ ঢাকা আসিয়া হাম্মাদিয়া মাদরাসায় আলেম শ্রেণিতে ভর্তি হইলেনইহার পরে ঢাকার এই মাদরাসায় কতদিন ছিলেন এবং কোন্ পর্যন্ত পড়াশুনা করে ছিলেন, তাহা নিশ্চিতরূপে জানা যায় নাই
উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে ঢাকা হইতে কোলকাতায় গমন

ঢাকা হইতে তিনি কলিকাতা আলীয়া মাদরাসায় ভর্তি হয়েছিলেনকলিকাতার এই আলীয়া মাদ্রাসায় নেছারুদ্দীন আহমদ কতদিন অধ্যয়ন করেছেন তাহাও সঠিকরূপে জানা যায় নাইতবে এই মাদরাসায়ও তিনি দীর্ঘদিন লেখাপড়া করেন নাইএর পর হুগলী মাদরাসায় ভর্তি হয়ে নেছারুদ্দীন আহমদ পূর্ববৎ মনোযোগ সহকারে লেখাপড়া করিতে থাকেন
তরীকায় ছবক গ্রহণের প্রথম দিনঃ

একদিন উক্ত মাদরাসায় কিংবা উহার সন্নিকটে কোথাও বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মোরশেদ ও হাদী হযরত মাওলানা আলহাজ্জ্ব শাহ্ ছুফী আব্দুল্লাহ ওরফে মোহাম্মদ আবু বকর ছিদ্দিকী একটি জলসা উপলক্ষে আগমন করেনএই মহাপুরুষের আগমন বার্তা শুনিয়া নেছারুদ্দীন আহমদ বিশেষ আগ্রহ নিয়ে ওয়াজ শুনিতে গেলেনমাগরিবের নামাজবাদ নেছারুদ্দীন আহমদ মোরশেদ প্রবরের পশ্চাদভাগে উপবেশন করলেনউক্ত মোরশেদ প্রবর নামাজের পরক্ষণে অপেক্ষমান লোকজনের দিকে ফিরিতেই এই তরুণ ছাত্রটিকে দেখিতে পাইলেন

দীপ্তিময় সংযত চেহারা বিশিষ্ট এই তরুণের দিকে দৃষ্টিপাত করে তিনি বলিলেনÑ “মুরীদ হবে বাবা?” কামেল সাধক ও তাপসগণ দীক্ষা দিবার জন্য কাহাকেও সচরাচর এইভাবে আহ্বান করেন নাকিন্তু এক্ষেত্রে তাহার ব্যতিক্রম ঘটলবিজ্ঞ তাপস তরুণের দীপ্ত ললাটে কী স্বাক্ষর অবলোকন করেছিলেন তা মহান আল্লাহই ভাল জানেনযাহা হউক, তখনকার তরুণ শিক্ষানবীশ নেছারুদ্দীন আহমদ সসম্ভ্রমে উত্তর দিলেনÑ “হুজুরের মেহরবাণীএই উত্তর শুনিয়া ফুরফুরার নেছারুদ্দীন আহমদ তখনই বয়াত করলেন এবং কলবমকামে ছবক দিলেনএই ছবকের প্রতিক্রিয়া তরুণ শিক্ষার্থীর উপর গভীরভাবে পতিত হইলমুরীদ প্রথম ছবকেই তন্ময় অবস্থা প্রাপ্ত হইলেনতরীকাপন্থীগণের পক্ষে এই অবস্থা প্রাপ্ত হওয়া খুব সহজলভ্য নয়দীর্ঘ দিন ধরিয়া একাগ্র সাধনায় এই উচ্চ শ্রেণীর অবস্থা প্রাপ্ত হওয়া সম্ভবনেছারুদ্দীন আহমদ এর প্রথম ছবকের প্রতিক্রিয়া মোরশেদ প্রবর তাহার এই অবস্থা টের পাইলেনএশার আজান হইলÑ সকলে নামাজের জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলেন, নব্য দিক্ষিত নেছারুদ্দীন আহমদ ইহার কিছুই টের পান নাই দেখিয়া তদীয় মোরশেদ বলিলেনÑ “ওঠ বাবা, এশার আজান হয়েছেএই কথায় তাঁহার চেতনা ফিরিয়া আসিলতিনি অপ্রস্তুতভাবে উঠিয়া গেলেন
সেদিনের মত কাজ শেষ হলনেছারুদ্দীন আহমদ তদীয় মোরশেদকেবলার নিকট হইতে বিদায় নিলেনবিদায়ের সময় মোরশেদ প্রবর তরুণ মুরীদকে বললেনÑ “আমার সহিত আবার দেখা করিও

নেছারুদ্দীন আহমদ এর জীবনে আকস্মিকভাবে এই ঘটনা ঘটিয়া গেল, ইহার পর হইতে তাঁহার জীবনে একটি নূতন ধারার সংযোগ হইলতদীয় পীর সাহেবের নির্দেশক্রমে তিনি পুনঃ তাঁহার সহিত মোলাকাত করিবার জন্য ব্যাকুল হইলেনঅতঃপর একনি তিনি তাঁহার মোর্শেদের সন্নিধানে কলিকাতা চলিয়া গেলেন
পরবর্তীতে হযরত নেছারউদ্দীন আহমদ (রহঃ) এর জবানীতে কয়েকবারই শুনা গিয়াছে, তিনি অশ্রু বিগলিত চক্ষে বলিয়াছেনÑ “হুগলী হইতে নেছারুদ্দীন আহমদ কেবলার সহিত সাক্ষাত করিতে কলিকাতায় গিয়াছিলাম কিন্তু, আজ দীর্ঘ পয়তাল্লিশ বৎসর পর্যন্ত এই কথা স্মরণ করিতে পারি নাই যে, কিভাবে আমি কলিকাতায় গিয়াছিলাম
জীবনে নূতনধারা

মারেফতের দীক্ষা গ্রহণের পর মূলতঃ বিদ্যালয় ভিত্তিক লেখাপড়ার সমাপ্তি ঘটিলপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজগত ছেড়ে নেছারুদ্দীন আহমদ তদীয় মোর্শেদ কামেলের সাহচর্যলাভ করে মারেফতের এক বিশাল শিক্ষা রাজ্যে প্রবেশ করলেনতখন সংসার খুব একটা স্বচ্ছল ছিলনাপিতৃহীন সংসারে মায়ের একমাত্র ভরসা নেছারুদ্দীনতাই তাকে রোজগারের চিন্তা ফেকের করতে হতকিন্তু কামেল মোরশেদের দৃষ্টিমাত্র লাভ হওয়াতে তিনি এক মহাজীবনের সন্ধান পাইলেনকাজেই তিনি এখন সকল দিক হইতে মোরশেদ সংগ-লাভ ও তরীকা শিক্ষাকে জীবনের মহান লক্ষ্য হিসাবে ধরে নিলেন

মোরশেদের নিকট তিনি অল্পদিনেই খুব প্রিয় হয়ে উঠেনতদীয় মোরশেদ কেবলা তাঁহার ভিতরে এক অসাধারণ প্রতিভা দেখিতে পাইয়া তাঁহাকে বিশেষ যতœসহকারে সর্ববিষয়ে শিক্ষাদান করিতে লাগিলেনফুরফুরা শরীফে তদীয় মোরশেদ কেবলার বাসস্থান এবং খানকাহ্ ছিলতিনি কখনও কখনও কলিকাতায় আসিয়া অবস্থান করতেনছারছীনার নেছারুদ্দীন আহমদ অতঃপর নিয়মিতভাবে তদীয় মোরশেদের দরবার শরীফে যাতায়াত করিতে আরম্ভ করেনকখনও কখনও মাসাধিক কালও পীরের সাহচর্যে অবস্থান করে তরীকার ছবকাদি বিশেষ একাগ্রতা সহকারে গ্রহণ করতেনআবার তিনি পীর কেবলার নির্দেশ মতই বাড়ীতে আসিতেনসংসারে বৃদ্ধা জননী ছিলেন, স্ত্রীও ছিলেনসুতরাং সংসার রীতিমতই ছিলএকদিকে সংসার অন্যদিকে কামেল মোরশেদের সাহচর্য এবং আত্ম-গঠনের দুর্গম সাধনায় তিনি নিজের জীবন ব্যাপৃত করে রাখলেনপীর কেবলা তরুণ বয়সের সাগরেদের সাংসারিক দায়ীত্ব এবং বৃদ্ধা মাতার কথা জানিতেনবৃদ্ধা জননী কতদিনের জন্য পুত্রকে বাহিরে থাকিবার অনুমতি দিয়াছেন ইহা বিজ্ঞ মোরশেদ জিজ্ঞাসা করে জানিয়া লইতেনসময় অতীত হইলে তিনি নিজেই তাহাকে দেশে পাঠাইয়া দিতেনএইভাবে তিনি সাগরেদকে জীবনে এক বিরাট দায়িত্ব বহনের জন্য ধীরে ধীরে গড়িয়া তুলিতে লাগিলেন
তাবলিগী জীবনের শুরু

অল্প দিনের মধ্যে মোরশেদে কামেল তদীয় সাগরেদের যোগ্যতা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হইলেন এবং লোকদিগকে বয়াত করার এবং তরীকার তালীম দিবার আদেশ তথা মোবাল্লিগ বা প্রচারক রূপে খেলাফত দান করলেনএই প্রসঙ্গে নেছারুদ্দীন আহমদ বলিয়াছেন যে, তিনি লতিফার ছবকে থাকতেই তাহাকে তালীম দিবার খেলাফত দিয়াছিলেননেছারুদ্দীন আহমদ ইহাতে বিনয় বশত: নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু তদীয় দূরদর্শী কামেল মোরশেদ উত্তর করলেনÑ “আমি বলিয়া দিলাম ইহাই যথেষ্ট
মহান মোরশেদের এই করুণার দান ও পাহাড় সমান দায়িত্ব পরম শ্রদ্ধা ও শংকাভরে অবনত মস্তকে নেছারুদ্দীন আহমদ গ্রহন করলেন এবং সমাজে দাওয়াতের কাজ আরম্ভ করলেনপ্রাথমিক অবস্থায় পীর সাহেবের নিজ মহকুমা (বর্তমান জেলা) পিরোজপুরের দক্ষিণ অঞ্চল মঠবাড়িয়া থানাই ছিল তাঁহার দাওয়াতের প্রধান কেন্দ্রএই স্থানে তদীয় মরহুম ওয়ালেদ কেবলা ও দাদাজান কেবলার বহু সাগরেদ ছিলেনএবং অনেকেই বয়াত হইতে আরম্ভ করলেনএইভাবে তাঁহার তাবলিগী জীবন শুরু হইলফুরফুরা দরবার শরীফ হইতে ছারছীনার নেছারুদ্দীন আহমদকে যে খেলাফতনামা দেওয়া হইল তহাহার সনদপত্রের ফটোকপি এখানে ছাপাইয়া দেওয়া হইল
হেদায়াতের প্রথম জীবন

নেছারউদ্দীন আহমদ হাদীরূপে বাহির হয়ে দেশের আভ্যন্তরীন অবস্থা দেখিতে পাইলেনসমাজের আপাদমস্তক অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও নানাবিধ অনৈছলামিক আচারে পরিপূর্ণনামাজ, রোজা, জাকাত ও হজ্জ্ব প্রভৃতি আল্লাহর হুকুমসমূহ সমাজ হইতে লুপ্তপ্রায় হইতে চলিয়াছেইছলামী আদব আখলাক, ছালাম-কালাম, চাল-চলন, লেবাছ-পোষাক কচিৎ ও কদাচিৎ দেখা যাইতঝগড়া-কলহ, খুন-খারাবী, বিবাদ-বিসম্বাদ সর্বত্র ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলমামলা-মোকদ্দমা, হিংসা-বিদ্বেষ ও দলাদলী দেশের অজ্ঞ জনসাধারণের ভিতরে অভিশাপের ন্যায় আচ্ছন্ন করেছিলঅন্যদিকে হিন্দুয়ানী আচার-অনুষ্ঠান ও চালচলন মুছলমানগণ ক্রমান¦য়ে নিজেদের ভিতরে গ্রহণ করে নিয়েছিলপূজা-পার্বনে অবাধ যাতায়াত, মেলা-থৌল ও তদুপলক্ষে নৌকা-বাইছ, গান-বাজনা ইত্যাদি সকলই মুছলমান নির্বিচারে আপনার করে নিয়েছিলআল্লাহর ফরজ, রাসুলের ছুন্নৎ, ইছলামী জিন্দেগীর আদর্শ ও মহান শিক্ষা হইতে মুছলমান সমাজ একেবারেই গাফেল হয়ে পড়েছিলকচিৎ ও কদাচিৎ দুই চারিজন আলেম বিদেশ হতে এদেশে এসে থাকতেন কিন্তু তাঁরা দেশের এই ভিতরকার গলৎ দূরকরিতে সমর্থ না হওয়ায় দেশের জন্য ইহা এক মারাত্মক ক্ষতিকর বিষয় হয়ে উঠলতাঁরা ওয়াজ করতেন কিন্তু ইহাতে দেশের এই মারাত্মক ব্যধির উল্লেখযোগ্য কোন প্রতিকার হইত নাএই সকল অবস্থা অবলোকন করে নেছারউদ্দীন আহমদ বড় উদ্বিগ্ন ও ব্যথিত হইলেনতাঁহার দূরদর্শী মোরশেদ কামেল কেন যে তাহাকে এই সুকঠিন ব্রতে নিয়োজিত করেছিলেন তা তিনি তখন উপলব্ধি করতে পারলেনঅতঃপর তিনি তাঁর দাওয়াতী-জীবনে দেশের গোমরাহী দূর করতঃ ইছলামের শিক্ষা সৌন্দর্য্য, আল্লাহ ও রছুলের আহকাম প্রচার করিতে সমর্থ হইলেন
বসন্ত রোগে আক্রান্ত

এই সময় পীর নেছারদ্দীন (রহঃ) সাহেবের জীবনে একটি কঠিন পরীক্ষা উপস্থিত হইলতিনি হঠাৎ বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়িলেনজীবন বিপন্ন বলিয়া মনে হইলদীর্ঘ দিন ভুগিয়া তিনি এই কঠিন রোগ হইতে আল্লাহর অসীম করুণায় মুক্তি লাভ করেন বটে, কিন্তু রোগের ভীষণ আক্রমণ পীর সাহেবের অঙ্গে স্থায়ী ছাপ রাখিয়া গেলএই ব্যধিতে নাকের অগ্রভাগের একাংশের খানিকটা খসিয়া গিয়াছিলকণ্ঠনালীর ক্ষুদ্র মাংস ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলজিহ্বা ভীষণভাবে জড়তা প্রাপ্ত হয়েছিলএমনকি পূর্বেকার মত সুতীক্ষè ও স্পষ্ট কণ্ঠস্বর আর থাকিল নাতিনি প্রথম অবস্থায় অতি ধীরে ধীরে বিশেষ আড়ষ্টতার সঙ্গে কথা উচ্চারণ করতেননেছারুদ্দীন আহমদ নিজেই বলেছিলেন যে, “আমি আকলম’ (পার্শ্ববর্তী গ্রামের নাম) এই সোজা শব্দটিও উচ্চারণ করতে পারতাম নাডান হাতের কব্জা দুর্বল হয়ে গিয়াছিলতিনি কলম ধরিতে এবং লিখিতে বিশেষ বেগ পাইতেনলিখিতে গেলে অক্ষরগুলি আঁকাবাঁকা হয়ে যেত
রোগমুক্ত হয়ে তিনি মোরশেদ সন্নিধানে গেলেনমোরশেদ তাঁহার প্রিয় সাগরেদটির এহেন অবস্থা দেখিয়া বড়ই আক্ষেপ করেছিলেনসম্প্রতি তাঁহার মক্কাশরীফ যাওয়া আসন্ন জানিয়া তদীয় মোরশেদ তাঁহাকে জিহ্বার জড়ত্ব দূর হইবার জন্য মাকামে জিব্রাইলের সম্মুকস্থ পবিত্র কাবা গৃহের সংলগ্ন একখানা বিশেষ পাথর লেহন করিবার উপদেশ দিয়াছিলেননেছারুদ্দীন আহমদ মক্কা শরীফে তদীয়পীর কেবলার উপদেশ মত তাহাই করেছিলেনআল্লাহর মর্জি ইহার আশ্চর্য্য ফল পাওয়া গিয়াছিলক্রমান¦য়ে কণ্ঠস্বর অনেকাংশেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলপরবর্তী জীবনে এই জড়তা অতি অল্পই অবশিষ্ট ছিল
মক্কা শরীফ হিজরত

বসন্ত রোগে আক্রান্ত হইবার পূর্বেই পীর ছাহেব কেবলা মক্কা শরীফ হিজরত করিবার নিয়ত করেছিলেনজীবনের এই স্তরে তিনি আল্লাহ্ তায়ালার গভীর এশকের জজবায় আকৃষ্ট ছিলেনতিনি দেশের সর্বত্র শরিয়ত বিরোধী কার্যকলাপ ও আল্লাহর নাফরমানী দেখিয়া বিশেষভাবে বিচলিত হয়ে পড়িয়াছিলেনএই সমস্ত কারণে তিনি মক্কা শরীফে হিজরত করিবার দৃঢ় সংকল্প করেছিলেন
অবশেষে রোগমুক্ত হয়ে তিনি হিজরতের জন্য প্রস্তুত হইলেনমাতা, স্ত্রী ও জেষ্ঠ্য পুত্র শাহ্মোহাম্মদ মুজাহার এবং ছোট ভগ্নিপতি সহ জাহাজ যোগে পবিত্র মক্কাধামে চলিয়া গেলেনতবে তিনি এই রওয়ানায় পূর্ণ হিজরতের সংকল্প করেন নাইযদি সেখানে অনিবার্য কোন কারণে থাকা সম্ভব না হয় অথবা দেশে ফিরিয়া আসা অতিব প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে তবে তিনি দেশে ফিরিয়া আসিবেন এইরূপ নিয়ত করেছিলেনএই জন্যই বাড়ীঘর জায়গা জমি ইত্যাদি মেঝ ভগ্নিপতি জনাব কাছেম মুনশীর হাওয়ালা করে যান
মক্কা শরীফে পৌছিয়া একটি অস্থায়ী বাসা ভাড়া করে কিছুদিন তথায় অবস্থান করলেনকিন্তু মক্কা শরীফ থাকিবার নিয়ত করিলে কি হইবে! বাংলার কোটি কোটি মানুষকে ইছলামের পথ প্রদর্শন করা, তাঁহার ব্যতিক্রম কিরূপে হইবে? কাজেই ঘটনার চাকা সেই দিকেই ঘুরিতে লাগিল
মক্কা শরীফে কিছুদিন কাটিতে না কাটিতেই পীর সাহেবের স্ত্রী ছাহেরা খাতুন ও পুত্র শাহ মোহাম্মদ মুজাহার এন্তেকাল করেনএই ঘটনার পর মাতা সাহেবার পরামর্শে হজ্জ পর্ব সমাধা করে মাকে নিয়া দেশে প্রত্যাবর্তন করলেন
মক্কা শরীফ হইতে প্রত্যাবর্তন

নেছারুদ্দীন আহমদ পবিত্র মক্কা শরীফ হইতে মাতা সাহেবাকে লইয়া দেশে ফিরিয়া আসিলেনদেশে আসিয়া নিজ মোরশেদের সন্নিধানে চলিয়া গেলেনদীর্ঘদিন পরে মোরশেদ ও মুরীদের সহিত সাক্ষাৎ ঘটায় পরস্পর পরম আনন্দিত হইলেনমোরশেদ তাঁহার ভক্ত মুরীদকে দেখিয়া অধিকতর আনন্দিত হইলেন
অতঃপর নেছারুদ্দীন আহমদ কেবলা পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক জীবন আরম্ভ করলেনবৎসরে বহুবার তিনি নিজ মোরশেদের নিকট গমন করতেন এবং সেখানে দীর্ঘদিন অবস্থান করতঃ তরীকা মশ্ক করতেন এবং পীরের খেদগমত করতেনতিনি তাহার নিকট কেবল যে তরীকার ছবক গ্রহণ করতেন তাহাই নহে বরং জীবনের প্রায় সব বিষয়েই এবং জনগণকে হেদায়াত করিবার প্রণালীসমূহ একান্ত সুবোধ বালকের মত শিক্ষা করতেনআবার পীরের দরবার হইতে ফিরিয়া আসিলে সংসারের খেদমত করতেন এবং সময় মতো ছফরে বাহির হয়ে পড়তেনখুব বেশী দূরে নহে, মঠবাড়িয়া থানায় পিতা মরহুমের সাগরেদানের মধ্যেসেখানে আদর যত্ন ছিলআলেম ও ওস্তাদপুত্র হিসাবে তিনি প্রচুর ভক্তি ও সম্মান অর্জন করিতে সমর্থ হয়েছিলেনবিশেষতঃ শরিয়ত ও মারেফতের প্রতি বিশেষ একাগ্রতা ও লোকদিগকে আল্লাহর তাবেদারীতে অভ্যস্ত করাবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা লোক জনের আরও অধিক শ্রদ্ধা অর্জন করতে আরম্ভ করলতাবলিগী জীবনের প্রথমে মঠবাড়িয়া অঞ্চলের এই কেন্দ্রটুকু তাঁহার বড় প্রয়োজনে আসিয়াছিলএইখানে তিনি তাহার শিক্ষা ও আদর্শ প্রচার করিবার একটি অনুকুল ক্ষেত্র লাভ করলেনপ্রতি বৎসর কিছু সময় এইভাবে দাওয়াতের উদ্দেশ্যে বাহিরে অবস্থান করতেনঅবশিষ্ট সময় তিনি বাড়ীতে ও পীরের দরবারে কাটাইয়া দিতেন
পরদিন শনিবার পীর ছাহেব কেবলার অবস্থার উন্নতি হয় এবং অবস্থা অনেকটা আয়ত্বাধীন বলিয়া মনে হয়পরদিন রবিবার অবস্থার এতদূর উন্নতি হয় যে তিনি তৈয়ম্মুম সহকারে আছরের নামাজ বসিয়া আদায় করেনপীর ছাহেব কেবলার অবস্থার এইরূপ পরিবর্তন দেখিয়া সকলেই বিশেষ উৎফুল্ল হয়ে উঠেনএই সুস্থ্যতার সংবাদে বাড়ীর মসজিদে শত শত তালবে এলেম ও মাদরাসার মোদার্রেছীনসহ সকল মুরীদ মোতাকেদ শোকরানা দোয়া করেন
রাত ৮টার সময় পরিবারস্থ কেহ কেহ তওবা পড়িতে চাহিলে পীর ছাহেব কেবলা সকলকে নিকটে ডাকিতে বলেনইহাতে মোহতারামা বিবি সাহেবাদ্বয়, কন্যাগণ, পুত্রদ্বয় ও নাতী নাতনীগণ সকলেই উপস্থিত হনএবং পরিবারস্থ সকলকে তওবা পড়াইয়া দোয়া করেনতিনি এই সময় কিছুকাল পরিবারস্থ সকলকে অন্তিম উপদেশ দান করেন¯ুতঃ ইহাই পীর ছাহেব কেবলার সর্বশেষ সুস্থাবস্থা
ইহার পর অবস্থা পুনঃ অবনতীর দিকে যাইতে লাগিল১৬ই মাঘ বুধবার অবস্থার বিশেষ অবনতি ঘটিলডাক্তারগণ অবস্থা চিকিৎসার অতিত বলিয়া ধারণা করেনবৃহস্পতিবার এইভাবে কাটিল দুপুর পর্যন্ত শ্বাস বাড়িতে থাকে দুপুরের পর হইতে শ্বাস ক্রমশ: মন্দীভূত হইতে থাকেসন্ধ্যার পর বিশেষ কোন উদ্বেগ করিতে দেখা যায় না
রাত ৯টার পর অন্দর বাড়ীর সকলে আসিয়া দেখাশুনা করেনপীর ছাহেবের মধ্যম সাহেবজাদা আলহাজ্জ হযরত মাওলানা শাহ মোহাম্মদ ছিদ্দীক ছাহেব (রহঃ) হাতের শিরা ধরিয়া বসিয়া থাকেনএই অবস্থায় নাসিকাদ্বারা তিনটি হাঁচি দিতে দেখা যায়; সর্বশেষ হাঁচির সংগে সংগে হাতের শিরা নি¯ব্ধ হয়ে যায়তখন তিনি বুঝিতে পারেন যে পীর ছাহেব কেবলা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে চলিয়া গিয়াছেনমধ্যম সাহেবজাদা সজোরে কাঁদিয়া উঠিলেন এবং অন্দরের মহিলাগণকে তাড়াতাড়ি সরিয়া যাইতে বলিতেনতাহারা তাড়াতাড়ি করে সরিয়া গেলে খাদেমগণ আসিয়া মুখে পানি দিলে উহা গলধঃকরণ করেনএই অবস্থায় তাহার শেষ নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করেনইন্নালিল্লাহি অইন্না ইলাইহি রাজিউন
শাহ আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ (রহঃ)- এর গদ্দীনশীন হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ
মাহবুবে সোবহানী আশেকে রাসূল, মুহিয়ে সুন্নাত কুতুবুল আলম, গাওসে যামান, ইমামুল মুসলেমীন, পীরে দ¯গীর হযরত মাওলানা শাহ্ সূফী নেছারুদ্দীন আহমদ (রহঃ) ৮৭ বছর বয়সে ইংরেজি ১লা ফেব্রয়ারি ১৯৫২ সাল মোতাবেক বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত্রে ৯-৪৫ মিনিটের সময় সকল মুরীদ মোতাকেদীন, Íীয়-স্বজন, দেশ ও সমগ্র মুসলমান জাতিকে শোক সাগরে ভাসাইয়া আল্লাহ আল্লাহ জিকর করিতে করিতে ইহধাম ত্যাগ করে আল্লাহ পাকের দরবারে গিয়া উপস্থিত হনশুক্রবার লক্ষাধিক লোকের উপস্থিতিতে তাঁহার নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়
জানাজায় লোক সমাগম

হুজুরের ইন্তেকালের নিদারুণ শোকাবহ সংবাদ বায়ুবেগে সর্বত্র প্রচারিত হয়ে পড়েভোর হইতে দলে দলে চতুর্দিক হইতে লোক সমাগত হইতে থাকেজুমার পূর্বেই প্রায় পাঁচ হাজার লোকের বাড়িতে সমাবেশ হয়ভোর হইতে সারাদিন তাঁহারা হুজুরের জানাজায় শরীক হওয়ার জন্য ধীরভাবে অপেক্ষা করিতে থাকেন
জুমার বাদে একটি সাধারণ সভার অধিবেশন হয়উপস্থিত সকল লোক এই সভায় যোগদান করেনএই সভায় মরহুম পীর ছাহেব কেবলার পরিবারস্থ লোকজন, Íীয় স্বজন; জামাতাগণ, নিজ গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের প্রধান ব্যক্তিগণ, মাদ্রাছার মোদাররেছীন, ছাত্রবৃন্দ, পীর ছাহেবের উপস্থিত ছিলেনসর্বসমক্ষে হযরত পীর ছাহেবের তিরোধানের জন্য দুঃখ না করে শান্ত থাকিবার জন্য অনুরোধ করা হয় এবং পীর ছাহেব কেবলার প্রতিষ্ঠিত যাবতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি সহানুভূতি ও কর্তব্য পালন এবং তাঁহার আদর্শ ও শিক্ষা অনুযায়ী চলাই তাঁহার প্রতি ভালবাসা প্রকাশের উপায় এই কথা বুঝাইয়া দেওয়া হয়অতঃপর পীর ছাহেব কেবলার প্রধান সহকর্মী ছারছীনা মাদ্রাছার এসিঃ সেক্রেটারী মাষ্টার এমদাদ আলী ছাহেব পীর ছাহেব কেবলার উত্তরাধিকারী দুই পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্রকে গদীনশীন স্থির করার প্র¯াব উত্থাপন করিলে সকলে সেইমুহূর্তে তাঁহার হাতে তজদীদে বয়াৎ করেনঅতঃপর গদীনশীন পীর ছাহেব কেবলা অশ্রপূর্ণ নয়নে নিজ অক্ষমতা জ্ঞাপন করেন এবং পীর ছাহেব কেবলা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সকল প্রতিষ্ঠান ও আদর্শের প্রতি সকলের সহযোগিতা প্রার্থনা করে একটি নাতিদীর্ঘ খোৎবা দান করেনঅতঃপর আছরের নামাজ আদায় করা হয়আছর নামাজের বাদ হযরত পীর ছাহেব কেবলার জানাজা কুতুবখানা হইতে কবর স্থানের দিকে নেওয়া হয়লোকের এরূপ হুজ্জুম হয়েছিল যে, জানাজার মিছিল নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছিলগদীশীন পীর ছাহেব কেবলা জানাজার ইমামতি করেন
জানাজার নামাজ সমাধা হইলে পর গদীনশীন পীর ছাহেব কেবলা ঘোষণা করেন যে, পীর ছাহেব কেবলা কোন ঋণ রাখিয়া যান নাইযদি কেহ দাবীদার থাকেন, এই মুহূর্তে আমার নিকট হইতে উহা বুঝিয়া নিনআর যদি কাহারও অন্তরে কোনও কথা বা ব্যবহারের দাবি থাকিয়া থাকে তাহা ক্ষমা করে দিনবিশাল জনতা এই ঘোষণায় শুধু চোখের পানি বর্ষণ করিতে থাকে
অতঃপর লক্ষ লোকের অন্তরের ধন ও নয়নের মণি পীর ছাহেব কেবলার পবিত্র দেহ চিরদিনের জন্য মাটির কোলে সমর্পণ করে দেওয়া হয়গদীনশীন পীর ছাহেব, মেঝ পীর ছাহেব শাহফোছিদ্দী জামাতা মাওলানা আবদুর রহমান, হাজী ওছমান হাওলাদার, হাজী আঃ রহমান, হাজী মোঃ হোছাইন, মৌঃ আবদুল আজিজ, পীর ছাহেব কেবলার লাশ মোবারক কবরে স্থাপন করেনপীর ছাহেব কেবলা যেন মাটির পবিত্র আবরণে চিরতরে মুখ লুকাইতে লুকাইতে পশ্চিম গগনে মলিন সূর্য একটি দুঃখসময় রাত্রির ইঙ্গিত দিয়া অ¯াচলে মুখ ঢাকিলব্যথাহত বিশাল জনতা গভীর শোক বুকে চাপিয়া ধীরে ধীরে চারিদিকে বি¯ৃত হয়ে গেল
গদ্দীনশীন নেছারুদ্দীন আহমদ কেবলার খোৎবা
পরদিন ভোরে উপস্থিত স্থানীয় ও বিদেশাগত লোকগণের একটি বৈঠক মরহুম হযরত পীর ছাহেব কেবলার কুতুবখানার সম্মুখে অনুষ্ঠিত হয়দীর্ঘ ৬০ বৎসরের অধিককাল হযরত পীর ছাহেব কেবলা যে স্থানে বসিয়া জীবনের বিরাট কর্ম সাধনা করে গিয়াছেন সেই স্থান শূন্য দেখিয়া সকলেরই প্রাণ নিদারুণ বেদনায় খাঁ খাঁ করিতে থাকেসেইজন্য মরহুম পীর ছাহেব কেবলার জ্যেষ্ঠ ছাহেবজাদাকে (মরহুম পীরের অছিয়ত অনসারে) পীর ছাহেব কেবলার গদীনশীন হিসাবে তাঁহাকে সেই আসনে বসাইয়া তাঁহারই মুখে কিছু নছিহত শ্রবণ করিবার আগ্রহ প্রকাশ করেনসভার অনুষ্ঠান হয়
অতঃপর গদীনশীন পীর আল্লামা আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ ছাহেব একটি আÍহৃদয়গ্রাহী খোৎবা দেনখুৎবাটি নানাদিক দিয়া সময়োপযোগী এবং তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছিলউহার সারমর্ম এই যে, তিনি মরহুম হযরত পীর ছাহেব কেবলার মুরিদান, মোতাকেদীন, মাদ্রাছার দরবারের পরিচালকবৃন্দ এবং জামাতাগণ ও অন্যান্য আÍীয় স্বজনের সঙ্গে মরহুম হযরত পীর ছাহেব কেবলার ব্যক্তিগত আদর্শগত ও প্রতিষ্ঠানগত গভীর সম্পর্কের কথা সকলকে স্মরণ করাইয়া দেনতিনি বলেন যে, মরহুম পীর ছাহেব কেবলার মাছলাকঅর্থাৎ নীতি ও আদর্শের প্রতি আমরা যতক্ষণ কায়েম থাকিব ততক্ষণ আপনারা আমাকে ভালবাসিবেন এবং মরহুম পীর ছাহেব কেবলার গদীনশীন হিসাবে আপনাদের খেদমত করিবার লায়েক থাকিবÑ যদি আমি আদর্শ বিচ্যুত হই, তবে আপনারা আমাদিগকে সতর্ক করিবেনÑ ইনশাআল্লাহ আমরা সতর্ক হয়ে যাইবআপনারা দোয়া করুণ আল্লাহর রহমত আমাদের সকলের উপর বর্ষিত হয়তিনি বত্তৃতা প্রসঙ্গে একথাও বলেন যে, হযরত পীর ছাহেবের প্রতি শ্রদ্ধার অর্থ হইল আল্লাহ ও রছূলের পথে কায়েম থাকামুরিদ মোতাকেদ, Íীয়স্বজন যে কেহ উহা হইতে বিচ্যুত হইবে তাহার সহিত আমাদের সম্পর্ক আল্লাহ ও রছুলের নির্দেশ মতোই হইবে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন