সংলাপ হবে, হবে না!
একমাত্র জরুরি অবস্থা জারি হলেই এই অধিকার স্থগিত করা যায়। দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়নি, এটা আমরা সবাই জানি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যেসব দল অনুমতি নিয়ে সমাবেশ দুর্বৃত্তদের হাতে তুলে দেয় এবং জনসাধারণের ওপর অন্যায়-অত্যাচার ও জ্বালাও-পোড়াও করে তাদের আগামী এক মাস সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না। এই এক মাসের সময়সীমা কবে থেকে শুরু হয়েছে এবং কবে শেষ হবে সেটা অবশ্য মন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেননি। প্রশ্ন হচ্ছে, এক মাস পর এরা ভালো হয়ে যাবে, আর জ্বালাও-পোড়াও-ভাঙচুর করবে না_ এই গ্যারান্টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে কে দিয়েছে? একই সঙ্গে জানতে ইচ্ছা করে এতবড় একটা সিদ্ধান্ত কি তিনি একাই নিয়েছেন? এ ব্যাপারে সরকারের নীতিনির্ধারকরা কি একমত পোষণ করেন? যদি আলাপ-আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে তাহলে এ নিয়ে একেক মন্ত্রী একেকরকম ব্যাখ্যা দিচ্ছেন কেন? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেও এর যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে তিন রকম বক্তব্য দিয়েছেন। যদি ধরে নেওয়া হয় 'জনগণের ওপর অন্যায়-অত্যাচার ও জ্বালাও-পোড়াও' করায় সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণ হয়ে থাকে তাহলে প্রশ্ন আসে যারা এটা করছে তাদের ওপর শর্তসাপেক্ষে নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করে ঢালাওভাবে সবার ওপর এ ধরনের অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া কেন? একজন শান্তিভঙ্গ করেছে বা করবে_ এই আশঙ্কায় অন্যজনের অধিকার কেড়ে নেওয়ার স্বেচ্ছাচারিতা কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না, মেনেও নেওয়া যায় না।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় মহাসেনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে এক মাস সভা-সমাবেশ করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে দারুণ সাফাই ব্যাখ্যা দিয়েছেন সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক! কিন্তু তার এই ব্যাখ্যা দেশবাসীকে সন্তুষ্ট বা আশ্বস্ত কোনোটাই করতে পারেনি। বরং এসব হাস্যকর বক্তব্য সরকারের উদ্দেশ্যের সততাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপকূলীয় অঞ্চল। আর ত্রাণকাজে সুবিধার জন্য ঢাকায় সভা-সমাবেশ করা যাবে না! ছেলে ভোলানো কথা বলে লোক হাসানোর পথ অবিলম্বে পরিহার করা উচিত। দেশের মানুষ এসব ছেলেমানুষি একেবারেই পছন্দ করে না।
এটা ঠিক, সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠানের নামে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে মারাত্দক সব আইনবিরোধী ঘটনা ঘটেছে। শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়েছে। সাধারণ মানুষ অসহায় ও আতঙ্ক বোধ করেছে। বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির এবং হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ থেকে একাধিকবার বড় ধরনের হিংসাত্দক ঘটনা ঘটেছে। জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এমনকি শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যদের ওপরও আক্রমণ করা হয়েছে। তাদের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছে, মাথা থেঁতলে দেওয়া হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে। এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কোনো বিবেচনায়ই গণতন্ত্রসম্মত নয়। গণতন্ত্রের নামে এসব কার্যকলাপ চলতে পারে না। কোনো গণতান্ত্রিক দেশেই এসব অপরাধমূলক কাজ চলতে দেওয়া হয় না। সভা-সমাবেশ যাতে শান্তিপূর্ণ হয় তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। বিএনপি-জামায়াত-শিবির কিংবা হেফাজতের সমাবেশ শান্তিপূর্ণ হবে_ এই অঙ্গীকার করেই সমাবেশের অনুমতি নিয়ে তারা কথা রাখেনি, অঙ্গীকারের খেলাপ করেছে। যারা অঙ্গীকার খেলাপি তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করলে কারও কিছু বলার থাকে না। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক মাস কাউকেই সমাবেশ করতে না দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাতে লাভ হয়েছে বিরোধী পক্ষের, ক্ষতি হয়েছে সরকারের। অন্যের যাত্রাভঙ্গ করে নিজের নাক কাটা একেই বলে!
হেফাজতের ঢাকা অবরোধকে কেন্দ্র করে ৫ ও ৬ মে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে যে ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে, তাতে কেবল হেফাজত নয়, বিএনপি এবং জামায়াত-শিবিরও যথেষ্ট কোণঠাসা অবস্থায় পড়েছিল। তাদের এ আচরণ কতটুকু গণতান্ত্রিক এবং এসব ধ্বংসাত্দক কর্মকাণ্ড অবাধে চলতে দেওয়া যায় কিনা, সে প্রশ্ন এখন মানুষের মনে প্রবল হয়ে উঠছে। তাদের নৈতিক অবস্থান যখন দুর্বল হয়ে পড়েছে তখনই যেন তাদের উদ্ধারে এগিয়ে এলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বিএনপি-জামায়াতের সমর্থন নিয়ে হেফাজতে ইসলাম দেশের ভেতর যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছিল, তা নিয়ে কথা না বলে এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তুঘলকি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই কথা বলছেন অনেকে। সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ভবনের স্তম্ভ ধরে নাড়াচাড়া করায় ভবন ধসের একটি কারণ হতে পারে বলে বালখিল্য মন্তব্য করে হাসির পাত্র হয়েছিলেন। তার এই উদ্ভট তত্ত্ব অনেককেই ক্ষুব্ধ করেছিল। প্রশ্ন উঠেছিল তার বিচারবুদ্ধি নিয়েও।
ওই বক্তব্যের রেশ কাটতে না কাটতেই এক মাসের জন্য ঢাকায় সভা-সমাবেশ করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরকারের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তির ওপর যে কালিমা লেপন করলেন তা এক কথায় অমোচনীয়। সাহারা খাতুনকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে দায়িত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়তো আশা করেছিলেন একজন সাবেক আমলা এবং তার আগের আমলের প্রতিমন্ত্রী এবার পূর্ণমন্ত্রী হয়ে দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে সরকারের মেয়াদের শেষ দিনগুলো নির্বিঘ্ন করে তুলবেন। কিন্তু হায়। জিয়ার খাল কাটা বিপ্লবের সারথি কী শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি উজ্জ্বলে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারেন? ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের কারণেই শেষ সময়ে সরকারকে না জানি আরও কত হোঁচট খেতে হয়।
বর্তমান সময়টা সরকারের জন্য খুব সুবিধার নয়। সরকারের মেয়াদকাল শেষ হয়ে আসছে। আর মাত্র কয়েক মাস পরই সরকারকে ক্ষমতা ছেড়ে নতুন নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হবে। সেই নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে চরম বিরোধ চলছে। অনেকেই মনে করেন শেষ পর্যন্ত এই বিরোধের হয়তো সম্মানজনক নিষ্পত্তি হবে না। যদি তাই হয় তাহলে দেশে আদৌ নির্বাচন হবে কিনা সেটা প্রশ্ন হয়ে উঠছে। কেউ মনে করেন আওয়ামী লীগ বিএনপিকে নির্বাচনী দৌড় থেকে বাইরে রাখতে চায়। কারণ মানুষ নানা কারণে সরকারের প্রতি কিছুটা অসন্তুষ্ট আছে। ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে তারা সরকারের বিরুদ্ধেই রায় দিতে পারে। আবার এমন কথাও শোনা যায় পরিস্থিতি যাই হোক না কেন বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেবে। নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির অস্তিত্বই সংকটের মুখে পড়বে। অন্যদিকে এমন মতও কেউ কেউ পোষণ করেন বিএনপি বর্তমানে যেভাবে জামায়াত ও হেফাজতের ওপর নির্ভর করে রাজনীতি করছে সেটা দেশের অধিকাংশ মানুষই সহজভাবে মেনে নিতে পারছে না। সরকারের ভুল-ত্রুটি আছে। সে জন্য মানুষের মনে যেমন ক্ষোভ আছে, তেমনি বিরোধী দলের প্রতিও মানুষের পূর্ণ আস্থা ও সমর্থন নেই। কাজেই পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করবেই, এটা নিশ্চিত করে বলার মতো অবস্থা দেশে বিরাজ করছে না। সব মিলিয়ে রাজনীতিতে চলছে এক ধরনের রৌদ্র-মেঘের খেলা। একবার মনে হচ্ছে সরকার এবং বিরোধী দল পয়েন্ট অব নো রিটার্নে গিয়ে দেশকে চূড়ান্ত সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আবার মনে হচ্ছে সংলাপের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত বুঝি প্রধান দুই দল একটি সমঝোতায় পেঁৗছতে সক্ষম হবে। কেউ বলছেন, সংলাপ হবে এবং এটা হতেই হবে। আবার কেউ বলছেন সংলাপ হবে না। দুই দল যদি জয়ের লক্ষ্যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজয়কে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়ার মানসিকতা নিয়ে অগ্রসর হতো তাহলে সংলাপ সহজ হতো। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, দুই দলই জয় চাচ্ছে। অথচ নির্বাচনে একই সঙ্গে দুই দলের জয়লাভের কোনো সুযোগ নেই। দুই দলের মধ্যে যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছে তার পরিণতি কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। সরকার যেমন খুব ভালো অবস্থানে নেই, তেমনি বিরোধী দল খুব ভালো আছে সেটাও বলা যাচ্ছে না। তাই একবার সংলাপ হবে বলে মনের মধ্যে আশা জাগছে আবার পরক্ষণেই সংলাপ হবে না বলে হতাশার অন্ধকার নেমে আসছে দেশবাসীর সামনে। এই আলো-আঁধারি থেকে সত্যি মুক্তি মিলবে কি?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন