মৌলিক কণা
আধুনিক
পদার্থবিদ্যার মুখ্য উদ্দেশ্য একটা প্রশ্নের সঠিক উত্তর খুজে বের করা তা হল এই “মহাবিশ্ব কি দিয়ে তৈরি?”। এছাড়াও আরও একটা প্রশ্নের সম্মুখীন বিজ্ঞানীরা হয়ে আসে তা
হল “পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা কি ?”এই সব প্রশ্নের তদন্তের লাইন অ্যা্রিস্টটল, ডেমোক্রিটাস, ডাল্টন এবং রাদারফোর্ড থেকে শুরু হয়ে এখনো চলতেছে।আর সেই সাথে বিজ্ঞানের একটি শাখাও তৈরি হয়েছে যার নাম “Particle
Physics বা কণা
পদার্থবিজ্ঞান”। প্রথমে
মনে করা হত, পরমানুর কেন্দ্র
একাধিক ইলেকট্রন এবং বিভিন্ন সংখ্যক পরাআধানযুক্ত কণিকার দ্বারা গঠিত। এগুলোর নাম দেয়া হয়েছিল প্রোটন। আসলে গ্রীক শব্দ প্রোটসের অর্থ প্রথম।কারণ তখন বিশ্বাস ছিল এগুলোই বস্তু গঠনের মূলগত একক। কিন্তু ১৯৩২ সালে কেম্ব্রিজে রাদারফোর্ডের সহকর্মী জেমস
চ্যাডউইক আবিষ্কার করলেন, কেন্দ্রে আরো
একটি কণাও থাকে তার নাম নিউট্রন। এর ভর প্রোটনের মতই কিন্তু এর কোন বৈদ্যুতিক আধান নেই। কেন নিউট্রনের চার্জ নেই তা পরবর্তীতে দেখানো হবে।আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে পর্যন্ত মনে করা হত, প্রোটন ও নিউট্রনই ‘মৌল
কণা’। কিন্তু কতগুলো পরীক্ষায় প্রোটনের সঙ্গে প্রোটনের সংঘর্ষ
ঘটানো হয়। প্রোটনের
এই পরীক্ষা থেকে নির্দেশ পাওয়া যায় আসলে এগুলোও ক্ষুদ্রত্ম কণা দ্বারা গঠিত। ক্যালটেক পদার্থবিদ মারে গেলম্যান এই কণাগুলোর নাম দেন
কোয়ার্ক। এই
নামের উৎপত্তি হয় জেমস জয়েসের একটা কবিতা “Three quarks for muster mark” থেকে। কণা পদার্থবিজ্ঞানে মৌলিক কণা বা প্রাথমিক কণা হল সেসব কণা, যাদের ক্ষুদ্রতর কোন ভিত্তি বা গাঠনিক একক নেই, অর্থাৎ এরা কোন ক্ষুদ্রতর কণার সন্নিবেশে গঠিত হয়নি। যদি কোন মৌলিক কণার প্রকৃতপক্ষেই কোন ক্ষুদ্রতর একক না থাকে
তবে তাকে মহাবিশ্বের গাঠনিক একক হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যা থেকে অন্য সব কণা তৈরি হয়েছে। আদর্শ মডেলানুযায়ী কোয়ার্ক, লেপটন এবং গেজ বোসনকে মৌলিক কণিকা হিসাবে বিবেচনা করা হয়।এখন আমাদের এই পরিচিত বিশ্বব্রক্ষান্ডের যত কণা আছে তাদের
সবগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগের নাম ফারমিওন, অন্য ভাগের নাম বোজন। পুরো বিশ্বব্রক্ষান্ড যেসব কণা দিয়ে তৈরি হয়েছে তার ভেতরে
যেগুলো ফারমিওন সেগুলোকে বলা হয় বস্তুকণা। যেগুলো বোজন সেগুলো এই বস্তুকণার ভেতরে বল বা শক্তির আদান
প্রদান করে। এখানে,
► ফার্মিয়ান কণা , এই কণাগুলো ফার্মি-ডিরাক সংখ্যায়ন মেনে চলে ।
► বোসন কণা , এই কণাগুলো বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন মেনে চলে ।
► ফার্মিয়ান কণা , এই কণাগুলো ফার্মি-ডিরাক সংখ্যায়ন মেনে চলে ।
► বোসন কণা , এই কণাগুলো বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন মেনে চলে ।
এদিকে, “Particle Physics বা কণা পদার্থবিদ্যায় হ্যাড্রন (Hadron) হচ্ছে এক ধরণের যৌগিক কণা বা কম্পোজিট পার্টিকেল, যা কোয়ার্ক দিয়ে গঠিত। তড়িৎচুম্বকীয় শক্তির সাহায্যে যেভাবে অণু ও পরমাণুসমূহ
পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকে, তেমনি কোয়ার্কও
পরস্পরের সাথে দৃঢ় শক্তির সাহায্যে সংবদ্ধ থাকে।
হ্যাড্রনকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছেঃ ব্যারিয়ন (তিনটি
কোয়ার্ক দিয়ে গঠিত) এবং মেসন (একটি কোয়ার্ক এবং একটি অ্যান্টিকোয়ার্ক দিয়ে
গঠিত)”।যাইহোক আমরা যৌগিক কণা নিয়ে আলোচনায় না গিয়ে মৌলিক কণায়
ফিরে আসি।ফারমিওন নামের বস্তুকণাকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগের নাম কোয়ার্ক অন্য ভাগের নাম লেপটন।
ফারমিওন (প্রথম
পরিবার)
কোয়ার্ক - u- আপ কোয়ার্ক
d- ডাউন কোয়ার্ক
লেপটন – e- ইলেকট্রন
Ve- ইলেকট্রন নিউট্রিনো
কোয়ার্ক - u- আপ কোয়ার্ক
d- ডাউন কোয়ার্ক
লেপটন – e- ইলেকট্রন
Ve- ইলেকট্রন নিউট্রিনো
এদিকে নিউট্রন
এবং প্রোটন তৈরি হয় আপ ও ডাউন কোয়ার্ক দিয়ে। ১৯৬৮ সালে স্ট্যানফোর্ড লাইনার অ্যাক্সেলারেটর কেন্দ্রে এক
পরীক্ষা থেকে প্রমানিত হয়, প্রোটন দুটি আপ
ও একটি ডাউন কোয়ার্ক এবং নিউট্রন দুটি ডাউন কোয়ার্ক ও একটি আপ কোয়ার্ক নিয়ে গঠিত।
এখানে কোয়ার্ক ও লেপটনের চার্জ দেখানো হয়েছে। উপরে আমরা পেয়েছি কিভাবে নিউট্রন ও প্রোটন গঠিত হয়, নিচে প্রোটন ও নিউট্রনের চার্জ কেন ভিন্ন হয় তা দেখানো হল-
আমরা যা দেখি, এই স্বর্গে-মর্ত্যে সবই এই আপ কোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক ও ইলেক্ট্রন দিয়ে গঠিত বলে ধারণা করা হয়।কোন পরীক্ষন নির্ভর গবেষণা এদের বিভাজ্যতা এখনো দেখাতে পারেনি কিন্তু ১৯৫০ এর দিকে ফ্রিডরিখ ক্লাইড এক পরীক্ষা থেকে দেখেন যে, এই তিন ধরনের কণিকা ছাড়াও আরো এক ধরনের কণিকার সন্ধান পান, এর নাম নিউট্রিনো।একটা সাধারণ শক্তিসম্পন্ন নিউট্রিনো ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন মাইল অতিক্রম করার পরও এর গতিপথে হালকা পরিবর্তনও ঘটে না। মজার কথা হল, এই লেখাটি যখন পড়ছেন সূর্য কর্তৃক নিক্ষেপিত নিউট্রিনো আপনার শরীর ও পৃথিবী ভেদ করে চলে যাচ্ছে। শুধুমাত্র চোখের ভিতর দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে এক মিলিয়ন নিউট্রিনো চলে যাচ্ছে কেউ সেটা দেখছে না। এটা মোটামুটি একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার যে, পরিচিত পুরো বিশ্বব্রক্ষান্ড u,d,e,Ve এই চারটি কণা দিয়েই তৈরি করা সম্ভব। তবে শুধু যে এই চারটি কণা রয়েছে তা নয়, এর সাথে সাথে এই কণাগুলোর প্রতি পদার্থও রয়েছে।কাজেই আমাদের তালিকাটি পূর্ণ করতে হলে ফারমিওনের এই পরিবারে তাদের প্রতিপদার্থগুলো যোগ করতে হবে।
এতসময় আমরা বস্তুকণা নিয়ে আলোচনা করেছি এখন এই বস্তুকণার ভেতর বল বা শক্তির বিনিময় করার জন্য প্রয়োজন অন্য কণা এবং এই কণাগুলোর নাম হচ্ছে বোজন। প্রমিত মডেল বা Standard Model অনুযায়ী বোসন কণা হচ্ছে ৫ ধরনের -
• ৩ ধরনের গেজ বোসন (Gauge Bosons)
• ১ টি হিগস্ বোসন (Higgs Boson)
• ১ টি গ্রাভিটন (Graviton)
• ৩ ধরনের গেজ বোসন (Gauge Bosons)
• ১ টি হিগস্ বোসন (Higgs Boson)
• ১ টি গ্রাভিটন (Graviton)
কণা পদার্থ বিজ্ঞানে গেজ বোসন মহাকর্ষ বল (ধারনা করা হয় যে গ্রাভিটন কণার জন্য মহাকর্ষ বলের উৎপত্তি ) ছাড়া অন্য ৩ টি মৌলিক বলের বাহক হিসেবে কাজ করে আরো ভালভাবে বলতে গেলে গেজ তত্ত্ব ( Gauge Theory হচ্ছে এক ধরনের পরিমাপ তত্ত্ব ) অনুযায়ী এই কণাগুলোর আদান-প্রদানের মাধ্যমেই মৌলিক বলগুলোর উৎপত্তি । যদিও বিজ্ঞানীরা বল কে বূঝার জন্য ৪টি ভাগে ভাগ করেছেন । ৪ টি মৌলিক বল এবং মৌলিক এই ৪ ধরনের বল কে যে ৪ টি তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয় তা হচ্ছে নিম্নরুপ –
১) সবল নিউক্লিয় বল এবং এর জন্য তত্ত্বটি হচ্ছে Quantum Chromodynamics (QCD)
২) তড়িচ্চুম্বকীয় বল এবং এর জন্য তত্ত্বটি হচ্ছে Quantum Electrodynamics (QED)
৩) দূর্বল নিউক্লিয় বল এবং এর জন্য তত্ত্বটি হচ্ছে Flavordynamics
৪) মহাকর্ষ বল এবং এর জন্য তত্ত্বটি হচ্ছে Geometrodynamics
২) তড়িচ্চুম্বকীয় বল এবং এর জন্য তত্ত্বটি হচ্ছে Quantum Electrodynamics (QED)
৩) দূর্বল নিউক্লিয় বল এবং এর জন্য তত্ত্বটি হচ্ছে Flavordynamics
৪) মহাকর্ষ বল এবং এর জন্য তত্ত্বটি হচ্ছে Geometrodynamics
প্রমিত মডেল বা Standard Model অনুযায়ী গেজ বোসন ৩ ধরনের –
• ফোটন
• W ±এবং Z বোসন
• গ্লুয়োন
• ফোটন
• W ±এবং Z বোসন
• গ্লুয়োন
বোজন
ফোটন - কোয়ার্ক ও ইলেকট্রনের ভেতর শক্তি বিনিময় করে
Z নট – সকল ফারমিওনের ভেতর শক্তি বিনিময় করে
এবং ডাব্লিউ প্লাস/মাইনাস – সকল ফারমিওনের ভেতর শক্তি বিনিময় করে
গ্লুয়োন – শুধু কোয়ার্কের ভেতর শক্তি বিনিময় করে
ফোটন - কোয়ার্ক ও ইলেকট্রনের ভেতর শক্তি বিনিময় করে
Z নট – সকল ফারমিওনের ভেতর শক্তি বিনিময় করে
এবং ডাব্লিউ প্লাস/মাইনাস – সকল ফারমিওনের ভেতর শক্তি বিনিময় করে
গ্লুয়োন – শুধু কোয়ার্কের ভেতর শক্তি বিনিময় করে
উপরে বর্ণিত মাত্র চারটি ফারমিওন ও পাচটি বোজন কণা দিয়েই এই মহাবিশ্বের সকল পদার্থের গঠন ব্যাখ্যা করা সম্ভব কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভবপর হয় নি। ফারমিওনের যে পরিবারটির কথা বলা হয়েছে সেটা যথেষ্ট নয়, এর সাথে আরো দুটো পরিবার দরকার। বাকি দুটো পরিবার হচ্ছে-
ফারমিওন (দ্বিতীয় পরিবার)
কোয়ার্ক – c – চার্ম
S – স্ট্রেঞ্জ
লেপটন - µ – মিউওন
Vµ – মিউওন নিউট্রিনো
S – স্ট্রেঞ্জ
লেপটন - µ – মিউওন
Vµ – মিউওন নিউট্রিনো
ফারমিওন (তৃতীয় পরিবার)
কোয়ার্ক - t – টপ
b – বটম
লেপটন - τ – টাও
Vt – টাও নিউট্রিনো
b – বটম
লেপটন - τ – টাও
Vt – টাও নিউট্রিনো
এবং অবশ্যই এদের প্রত্যেকটির সাথে রয়েছে তাদের প্রত্যেকটির প্রতি পদার্থ। এখন প্রতিপদার্থ আলাদা করে না লিখে ছোট একটা ছকে আমরা বিশ্বব্রক্ষান্ডের সকল মৌলকণা লিখতে পারি।এই সকল কণা ব্যবহার করে পদার্থবিজ্ঞানের যে মডেল দিয়ে প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করা হয় সেটাকে বলা হয় স্ট্যান্ডার্ড মডেল।
প্রতিনিয়ত আমরা নতুন তথ্য তত্ত্বে সম্মৃদ্ধ হচ্ছি। আমাদের ব্যাখ্যার অতীত বিষয়গুলোকে ধীরে ধীরে আমরা জেনে যাচ্ছি।আর “বিজ্ঞানের জগতে শেষ বলে কিছুই নেই”।হয়তো
অদূর ভবিষ্যতে আমরা আরও কোন নতুন কণার সন্ধান পেতে পারি। বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে যাক, আর আমরাও তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।
► ► তথ্যসূত্র-
১. উইকিপিডিয়া
২. A Briefer History of Time by Stephen Hawking
৩. পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণার কথা- অজানার সন্ধানে
১. উইকিপিডিয়া
২. A Briefer History of Time by Stephen Hawking
৩. পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণার কথা- অজানার সন্ধানে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন