বর্তমান সংশোধিত সংবিধান রাজতন্ত্রের আভাস দিচ্ছে
রাজনীতিতে সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রতিনিয়ত উঠে আসছে নিত্যনতুন বিতর্ক। নির্বাচনের সময় তত্ত্বাবধায়ক না অন্তর্বর্তী সরকার- এ প্রশ্নে রাজনীতি উত্তপ্ত। আরও জটিল এক সাংবিধানিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হস্তান্তর ও মেয়াদ নিয়ে। এতে আছে সংসদ ভেঙে গেলেও প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছা করলে পরবর্তী কয়েক বছর বা ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। আশ্চর্য হলেও সত্য যে সংবিধানই তাকে এ ক্ষমতা দিয়েছে। সংবিধানের ৫৭(৩) অনুচ্ছেদ মতে, প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই ক্ষমতায় বহাল থাকবেন। পঞ্চদশ সংশোধনীর পর বর্তমান সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদ মতে- সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে 'মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে। তবে শর্ত থাকে যে, এই দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ উক্ত দফায় উলি্লখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।' বর্তমান বিশ্বে এ ধরনের নির্বাচন পদ্ধতি একটি বিরল ঘটনা। কেননা এভাবে তিন মাস আগে নির্বাচিত নতুন এমপিরা আগের এমপিদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। অর্থাৎ একই সময়ে একই আসনে দুজন এমপি থাকবেন। শুধু তাই নয়, নির্বাচনের সময় এমনকি নির্বাচনের পরেও ডিসি, এসপি, ইউএনওরা এ সরকারের অধীনেই থাকবেন। প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বস্তরে বর্তমান সরকারের লোকজন দিয়েই নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশনেরও তাদের নির্দেশনার বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না। তাই নির্বাচনের সময় বর্তমান সরকারের পক্ষপাত থাকবে অবশ্যম্ভাবী। অন্যদিকে অন্য কোনো দল নির্বাচনে জয়ী হলেও প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা না ছাড়লে করার কিছু থাকবে না, যদি না তিনি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে, একদম ডিসিসি নির্বাচন স্থগিতের মতো একই ফর্মুলায় এগোচ্ছে সরকার। কেননা সংসদের বিভিন্ন আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে আইনি বাহাস চলছে নির্বাচন কমিশনে। সরকারি দলের এমপিরাও মন্ত্রীদের দায়ী করছেন এই সীমানা নিয়ে। সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে তাকে কেন্দ্র করে কেউ সুপ্রিম কোর্টে মামলা করলে জাতীয় নির্বাচনের তফসিলও হয়তো ডিসিসি নির্বাচনের মতো আটকে যেতে পারে। এ জটিলতার কারণে নির্বাচনের ওপর আদালতের স্থিতাবস্থা আসতে পারে। আগামী বছরের জানুয়ারিতে সংসদের মেয়াদ শেষ হলে সংসদ সদস্যরা না থাকলেও প্রধানমন্ত্রী যেহেতু থাকবেন, তাই তিনি ওই সময়ে ১০-১৫ জন অনির্বাচিত উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারবেন অনায়াসে। এভাবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আগামী কয়েক বছর বা ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে আদালতের শরণাপন্ন হলে 'ডকট্রিন অব নেসেসিটি' হিসেবে তা আদালতের বৈধতা পেতে পারে। কেননা তিন মাসের জন্য সাংবিধানিক মেয়াদ নির্ধারণ করা বিগত ওয়ান-ইলেভেনের সরকারও সেভাবেই বৈধতা পেয়েছে।
যেহেতু আমাদের বর্তমান সংবিধানের কোথাও তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলা নেই, তাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো কারণে সংলাপ বা গ্রহণযোগ্য কোনো সমঝোতা না হলে নিশ্চিতভাবেই সরকারকে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে যেতে হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সংঘাত-হানাহানিতে না গিয়ে সরকার সংবিধানের বিদ্যমান এ বিধানের সুযোগটি নিতে চাইতে পারবে। কেননা ১৯৭৫ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে কোনো ধরনের নির্বাচন ছাড়াই ওই সময়ের সব সংসদ সদস্যকে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত ঘোষণা করে। সেই সঙ্গে কোনো ধরনের নির্বাচন ছাড়াই আজীবনের জন্য রাষ্ট্রপতি করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সবই তখন করা হয় সংবিধান সংশোধন করেই। তাই অযথা নির্বাচন না করে বছরের পর বছর ক্ষমতায় থাকার বিধান যখন পঞ্চদশ সংশোধনীতে করা আছে, তখন সরকার কেনই বা নির্বাচন দিতে যাবে? বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকার বিধান তো রয়েছেই। তাই ডিসিসির মতো একই ফর্মুলায় সীমানা নির্ধারণসহ যে কোনো আইনি জটিলতার অজুহাতে যদি জাতীয় নির্বাচনও বছরের পর বছর ঝুলে থাকে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে ২০১৩-এর বাস্তবতায় এটা কতটুকু সম্ভব তা আগামী দিনগুলোই নির্ধারণ করবে।
ডক্টর তুহিন মালিক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ