মহাকর্ষ তরঙ্গের সন্ধানে - নিউটন বনাম আইনস্টাইন
মহমতি আহজ্যাক নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কারের গালগল্পটা সবরাই কম বেশি জানা। আপেল পড়ার গল্পটার কথা বলছি। অনেকেই শুধু জানেই না বিশ্বাসও করে। আসলে এ গল্পের সত্যতা নেই। তখন লন্ডনে প্লেগ রোগ মহামরী আকার ধারণ করেছে। নিউটন প্লেগের হাত থেকে বাঁচতে লন্ডন ছেড়ে এক পাড়াগাঁয়ে গিয়ে উঠেছিলেন। সেখানেই তাঁর মাথায় মহাকর্ষ সুত্রটা আসে। ১৬৮৭ সালে তাঁর প্রিন্সিপিয়া অব ম্যাথমেটিকা বইটি প্রকাশ হয়। আর তাতেই সর্বপ্রথম মহাকর্ষ বল বা সুত্র জনসম্মুখে আসে। প্রায় তিন দশক নিউটন সেটা লোকচক্ষুর আড়াল করে রেখেছেলিনে। কেন রেখেছিলেন, সে কারণটা এখানে আলোচ্য নয়।
নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রের মুলসুর ছিল—মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুই পরস্পপরকে আকর্ষণ করছে। এই আকর্ষণ বলের মান বস্তু দুটোর ভরের গুণফলের সমানুপাতিক। এবং দূরত্বের বর্গের ব্যাস্তানুপতিক। এই আকর্ষণ বলকে মহাকর্ষ বা মধ্যাকর্ষণ বল বলে।
আরেকটু সহজ করে বলা যেতে পারে। দুটি বস্তুর ভর যত বাড়ে তত তাদের ভরের গুণফলের মানও বাড়ে। সুতরাং বস্তুদ্বয়ের ভর যত বেশি হবে তাদের মধ্যে ক্রিয়াশীল আকর্ষণ বলের মানও তত বাড়বে। আবার বস্তু দুটোর দূরত্ব যদি বাড়ে তবে তাদের মধ্যে আকর্ষণ বলের মান কমবে। এই কমার হার বর্গাকারে। অর্থাৎ দূরত্ব যদি বেড়ে দ্বিগুণ হয় তবে মহকর্ষ বলের মান কমে আগের মানের এক চতুর্থাংশে নেমে আসবে।
নিচের চিত্রে পৃথিবী ও চাঁদের মধ্যকার মহকর্ষ বলের গাণিতিক রূপ দেখানো হয়েছে।
শুধু মহাকর্ষ বল আবিষ্কার করেই ক্ষান্ত হননি নিউটন। প্রিন্সিপিয়া অব ম্যাথমেটিকাতে প্রকাশ করলেন গতির বিখ্যাত তিন সমীকরণ।
১) বাহ্যিক কোনো বল প্রয়োগ না করলে স্থির বস্তু চিরকাল স্থির, গতিশীল বস্তু সুষম গতিতে অনন্তকাল ধরে চলতে থাককে। অর্থাৎ কোনো শূন্যস্থানে ধরা যাক মহাবিশ্বের কোনো স্থানে যেখানে কোনোপ্রকার মহাকর্ষ বা অন্য কোনো আকর্ষণ বলের প্রভাব নেই। সেখানে কোন স্থির বস্তুকে রেখে দিলে সারাজীবন সেটা স্থির থাকবে। কোনো বস্তুকে ধরা যাক ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার গতিতে ছেড়ে দেয়া হল, তাহলে সেই বস্তু অনন্তকাল ধরে ওই দশ কিলোমিটার গতিতেই চলবে। তার বেগ বাড়াতে বা কমাতে বা তাকে স্থির করতে হলে বাইরে থেকে কোনো বল প্রয়োগ করতে হবে।
২) কোন বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনের হার প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক এবং বল যে দিকে ক্রিয়া করে বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তন সেদিকেই ঘটে।
কোনো বস্তু স্থির থাকলে তার ভরবেগ শুন্য হবে। কারণ ভরবেগ হলো ভর আর বেগের গুণফল। ভর যতই হোক বেগ যদি শুন্য হয় তবে ভরবেগের গুণফলও শুন্য হবে। মানে ভরবেগও শূন্য হবে।(ভর X বেগ = ভরবেগ। এখন যদি ভর=১০ কেজি এবং যদি বেগ=০ হয়, তবে ভরবেগ=ভর X বেগ=১০X০=০)।
প্রথম সূত্রানুসারে, কোনো স্থির বস্তু গতিশীল করতে হলে বাইরে থেকে বল প্রয়োগ করতে হবে। তখন বস্তুটি একটা ভরবেগ প্রাপ্ত হবে। আবার একটা নির্দিষ্ট ভরবেগের বস্তুকে বল প্রয়োগ করলে তার ভরবেগের পরিবর্তন ঘটে। এই পরির্তনের হার যে বল প্রয়োগ করা হয় তার সমানুপাতিক। মানে বল যত বাড়ানো ভরবেগের পরিবর্তন বেশি হবে।
বস্তুর ভরবেগ একটা নির্দিষ্ট দিকে ক্রিয়া করে। বল যেদিকে ক্রিয়া করবে বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনও সেদিকে ক্রিয়া করবে।
৩) প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীতমুখি প্রতিক্রিয়া আছে।
নিউটনের তৃতীয় সূত্রটা বোধহয় পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় সূত্র। এই সূত্র ব্যাখা করার প্রয়োজনে বলে মনে করছি না।
মহকর্ষ সুত্রের সাথে গতির এই তিন সুত্র বদলে দিল বিজ্ঞানের ইতিহাস। বলতে গেলে এদের মাধ্যমেই জন্ম হল আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের। এদের দ্বারা মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্রগুলোর গতিপ্রকৃতি যেমন বোঝা সম্ভব হল, তেমনি নদী-সমুদ্রে জোয়ার-ভাটার রহস্য বেরিয়ে এলো। মহাকাশ আর পৃথিবী একই নিয়মে বাঁধা—তাও মানুষ জানতে পারল এই সূত্রগুলোর সাহায্যে।
নিউটনীয় গতিবিদ্যার ত্রুটি:
মহকর্ষ ও গতির সুত্রগুলো লক্ষ্য করলে একটা ত্রুটি খব সহজেই আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। সেটা হল, এগুলোতে শুধু মাত্র স্থানের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ত্রিমাত্রিক জগতের ব্যাখ্যা এই সুত্রগুলোর সাহয্যে বের করে ফেলা যায়। কিন্তু যখনই সময়ের হিসেব এতে আনবেন তখনই ভেঙে পড়বে নিউটনীয় গতিবিদ্যার সূত্রগুলো।
কিছুদিন আগে আমি জিরো টু ইনফিনিটিতে ‘আপক্ষিকতার কতটুকু বুঝি’ শিরোনামের লেখায় পাঁচটা প্রশ্ন ও তাঁর ব্যাখার অবতরাণা করছিলাম। সেই প্রশ্ন ৫টার ৪টা এখানে আবার উত্থাপন করতে পারি-
প্রশ্ন-২: মনে করুন, আপনি একটা ছাদখোলা ট্রাকে বসে আছ। ট্রাকটা এক সেকেন্ডে দশ মিটার বেগে ছুটছে। আপনার হাতে আছে একটা টেনিস বল। বলটা আপনি আলতো করে সোজা ওপরের দিকে ছুড়ে মারলেন। বলটা ওপর দিকে উঠে আবার আপনার হাতে ফিরে এলো। ওপরে উঠতে এবং আবার আপনার হাতে ফিরে আসতে বলটার সময় লাগল ২ সেকেন্ড। কথা হচ্ছে, ট্রাকটা যেহেতু সেকেন্ড ১০ মিটার বেগে ছুটছে। তাই এই ২ সেকেন্ডে সে ২০ মিটার সামনে এগিয়ে গেছে। আর বলটাও ওই সময় শূন্যে ভাসাছিল তাহলে বলটা আপনার হাতে না পড়ে বিশ মিটার পেছনে পড়ার কথা। কেননা ওই সময়ে বলটা বতাসে ভেসে ছিল—ট্রাক বা আপনার হাতের সাথে ওটার কোনো সংযোগই ছিল না। প্রশ্ন হচ্ছে, কোন অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে বলটা ট্রাকের পেছনে রাস্তার ওপর না পড়ে আপনার হাতের ওপর পড়ল? নাকি আদৌ আপনার হাতে ফিরে আসবে না।
প্রশ্ন-৩ : ধরুন, আপনি একটা চলন্ত গাড়িতে বসে আছেন। আপনার গাড়ির গতি ঘন্টায় ১০০ কিলোমিটার। বপরীত দিক থেকে আরেকটা গাড়ি ঘন্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে আপনার গাড়িকে পাশ কাটিয়ে আপনার পেছন দিকে চলে গেলে। ঠিক সেই সময় আপনার কাছে সেই গাড়িটার গতি কত বলে মনে হবে?
প্রশ্ন-৪ : এবার ভাবুন, আপনি যে গাড়িতে বসে আছেন সেই গাড়ির পাশে পাশে সমান বেগে আরেকটা গাড়ি একই দিকে যাচ্ছে। এবার ওই গাড়িটার যাত্রীদের দিকে তাকালে আপনার কী মনে হবে—ওই গাড়ির গতি আপনার গাড়ির থেকে বেশি, কম নাকি সমান?
প্রশ্ন-৫ : আপনার গাড়ি চলছে। রাস্তার পাশের একটা বৈদ্যুতিক পিলারকে অতিক্রম করে যাবার সময় পিলারকে আপনার কাছে স্থির মনে হবে নাকি গতিশীল? গতিশীল মনে হলে তার গতি কত হবে? কেন মনে হবে? মনে করুন আপনার গাড়ির গতি ঘন্টায় ১০০ কিলোমাটার।
প্রশ্ন চারটির দিকে খেয়াল করুন, এগুলোর একটারও ব্যাখ্যা কিন্তু নিউটনীয় গতিবিদ্যা দিতে পারে না।
এইবার মনের ভেতরে খচখচ আরো কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারি-
আগেই বলেছি মহাকর্ষ সূত্রে সময়ের কথা বলা হয়নি। এমনকি গতি সুত্রগুলোতেও যে সময়ের কথা বলা হয়েছে সবই নির্দিষ্ট। সেগুলো থাক, আপতত মহকর্ষ সূত্রের কথাই ধরাযাক, মহকর্ষ বলের যে মানের কথা বলা হয়েছে, সেখানে সময়ের কি কোনো প্রভাব থাকবে না? বলতে চাচ্ছি একটা বস্তু ওপর আরেকট বস্তুর মহাকর্ষ বলের ক্রিয়া সংগঠিত হতে কত সময় লাগবে। মানে দুটোর কোনো একটা বস্তুর যদি ভরের পরিবর্তন হয় তাহলে তাদের মহকর্ষ বলের পরিবর্তন হবে, পরিবর্তটা হতে কত সময় লাগবে। পৃথিবী আর সূর্যের কথাই ধরা যাক। সূর্যের মহাকর্ষ টান আর পৃথিবীর রৈখিক বলের পারস্পপরিক ক্রিয়ার কারণেই পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব মোটামুটি ১৫ কোটি কিলোমিটার। ধরা যাক, মাহাশের আরেকটি বিরাট নক্ষত্র কক্ষচূত্য হয়ে সূর্যের ওপর এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তাল সামলাতে না পা পেরে সূর্যি অবস্থান থেকে খানিকটা সরে গেল। ফলে পৃথিবীর সাথে তাঁর দূরত্বের হেরফের হলো। ফলে মহকর্ষ বলের মানেরও পরির্তন ঘটবে। কিন্তু পৃথিবী ঠিক কখন টের পাবে মহকর্ষ বলের পরিবর্তন হয়েছে। তা কি সূর্যের অবস্থানচূত্য হওয়ার সাথে সাথে নাকি পরে? কত পরে?
(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন