পারমানবিক বিদ্যুৎ ও বাংলাদেশ
আমি এখানে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কি, কিভাবে এর থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যয়, পরিচালনা, নিরাপত্তা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সুবিধা – অসুবিধা ,ঝুঁকি সহ আমাদের দেশে এই প্রযুক্তি পরিচালনার প্রয়োজনীয় দক্ষতা নিয়ে আলোচনা করব।
পারমাণবিক বিদ্যুৎঃ
সব ধরনের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে পড়ন্ত পানি, কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল কিংবা পারমাণবিক জ্বালানীর শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জেনারটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয় (ব্যতিক্রম: সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র)। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো মূলত দুই প্রকার। হাইড্রলিক বা জলবিদুৎ এবং থার্মাল বা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এছাড়া সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও জিও-থার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রও এখন দেখা যায়।
তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো আবার জ্বালানীর উৎস ভিত্তিতে দুই রকম - জীবাশ্ম জ্বালানী বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে জ্বালানি পুড়িয়ে তাপ উৎপাদনের ব্যবস্থা করা হয়। জীবাশ্ম জ্বালানি কেন্দ্রগুলোতে কয়লা, তেল বা প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহৃত হয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পারমাণবিক চুল্লিতে (Nuclear Reactor) তেজস্ক্রিয় আইসোটেপের দহনে তাপ উৎপন্ন হয়। উৎপন্ন তাপ বয়লার সিস্টেমের মাধ্যমে পানিকে বাষ্পীভূত করে। উৎপাদিত বাষ্প স্টিম টারবাইনকে সক্রিয় করে। টারবাইনের সঙ্গে যুক্ত অলটারনেটর (এক ধরনের জেনারেটর) বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। অলটারনেটরের একটি বিশেষ অংশ মোটর, ইজ্ঞিন বা অন্য কোনো উপায়ে ঘোরালে পরিবর্তী বৈদ্যুতিক প্রবাহ (alternating current) সৃষ্টি হয়। এই ব্যবস্থা যান্ত্রিক শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপাণ্তরিত করে।
প্রচলিত অর্থে নিউক্লিয়ার পাওয়ার বা কেন্দ্রীণ ক্ষমতা হলো পারমাণবিক চুল্লিতে কেন্দ্রীণ বিভাজন থেকে প্রাপ্ত শক্তির ব্যবহার। এই তাপ শক্তি দিয়ে পানিকে বাষ্পে পরিণত করা হয়। বিভাজন বিক্রিয়া (Fission) ঘটে ভারি পরমাণুর কেন্দ্রীণ ভাঙ্গনের ফলে এবং তার ফলে যে শক্তি অবমুক্ত হয় তা রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে প্রাপ্ত শক্তির দশলক্ষ গুণ বেশি যেখানে শুধু জ্বালানি পোড়ানো হয়।
আমরা জানি প্রত্যেক পদার্থ পরমাণু নামক অসংখ্য অতি ক্ষুদ্র কণা দ্বারা গঠিত। সব মৌলের পরমাণুতে থাকে ইলেকট্টন, প্রোটন এবং নিউট্রন - এই তিনটি মূল কণিকা। নিউট্রন ও প্রোটন পরমাণুর কেন্দ্র নিউক্লিয়াসে অবস্থান করে। ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের বাইরে অবস্থান করে। পরমাণু সামগ্রিকভাবে কোনরূপ চার্জযুক্ত থাকে না। যেহেতু নিউট্রন চার্জবিহীন, সেহেতু পরমাণুতে ইলেকট্রন ও প্রোটনের সংখ্যা অবশ্যই সমান হবে। কেননা, প্রোটন ও ইলেকট্রনের আধান বিপরীতধর্মী ও সমপরিমাণের।
একই মৌলের বিভিন্ন পরমাণুর কয়েক প্রকারের ভর হতে পারে। (ভর = প্রোটন ও নিউট্রনের সর্বমোট সংখ্যা) যে সব পরমাণুর প্রোটন সংখ্যা সমান কিন্তু ভর সংখ্যা ভিন্ন হয়, সে সব পরমাণুকে পরস্পরের আইসোটোপ বলা হয়। অর্থাৎ নিউট্রনের সংখ্যার তারতম্যের জন্যই আইসোটপের সৃষ্টি। একই মৌলের সব আইসোটপের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম একই থাকে। কোন কোন পরমাণুতে পারমাণবিক কেন্দ্রিণের অস্থায়িত্ব থেকে যে প্রতিভাসের সৃষ্টি হয় তার নাম তেজস্ক্রীয়তা। এই অস্থায়িত্বেরকালে কেন্দ্রিণ এক স্বতঃস্ফুর্ত রূপান্তরের বা পরিবর্তনের মধ্যে পরে যায় এবং এর ফলে বিকিরণ নিঃসৃত হয়। ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, প্লুটোনিয়াম ইত্যাদি তেজস্ক্রিয় পদার্থ। এতক্ষণ যা আলাপ করলাম তার উদ্দ্যেশ্য পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জটিল প্রক্রিয়াকে বুঝতে সবার জন্য যেন সহজ হয়। এখন আসল কথায় ফিরে আসি।
পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে ভেঙ্গে যে শক্তি পাওয়া যায় তাকে পারমাণবিক শক্তি বলে। ১৯০৫ সালে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন প্রমাণ করেন যে, পদার্থ ও শক্তি প্রকৃতপক্ষে অভিন্ন অর্থাৎ পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তরিত করা যায় এবং শক্তিকে রূপান্তরিত করা যায় পদার্থতে। m ভরবিশিষ্ট কোন পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তরিত করলে যে শক্তি উৎপন্ন হয় তার পরিমাণ E=mc² এখানে c, আলোকের বেগ = 300,000 km/sec.
ফিশনের (Fission) শাব্দিক অর্থ বিভাজন। একটি ভারী পরমাণুকে দ্রুতগামী নিউট্রন দ্বারা ভেঙ্গে হালকা ভারের একাধিক পরমাণু ও শক্তি উৎপন্ন করার প্রক্রিয়াকে কাজে লাগানো হয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। যে সকল তেজস্ক্রিয় পদার্থ এই ফিশন বিক্রিয়ায় অংশ নেয় তাদের ফিসাইল পদার্থ বা পারমাণবিক জ্বালানী বলা হয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার হয় ইউরেনিয়াম-২৩৫ আইসোটোপ। মজার ব্যাপার হচ্ছে তেজস্ক্রিয় কিছু আইসোটোপ আছে যেগুলো বিশেষ অবস্থায় নিজেরাই নিজেদের পরমাণুকে ভেঙ্গে তাপশক্তি বিকিরণ করে।
ইউরেনিয়াম ২৩৫(৯২ ১৪৩)একটি সুস্থিত তেজস্ক্রিয় পদার্থ যার প্রতিটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসে ৯২টি প্রোটন ও ১৪৩ টি নিউট্রন আছে। এর পরমাণুতে বাহির থেকে একটি নিউট্রন ঢুকিয়ে দিলে তখন এটি ইউরেনিয়ামের অস্থিত (unstable) আইসোটোপ ইউরেনিয়াম ২৩৬ - এ পরিণত হবে। এই আইসোটোপটি নিজের অস্তিত্ব বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। তাই এর পরমাণুটি ভেঙ্গে দুটি সুস্থির পরমাণুতে (ক্রিপটন ও ব্যারিয়াম) পরিণত হবে। ভেঙ্গে যাওয়ার প্রাক্কালে পরমাণুটি প্রচুর তাপশক্তি উৎপন্ন করে দুটি অতিরিক্ত নিউট্রনকে মুক্ত করে দেবে। মুক্ত নিউট্রন দু’টি আবার ইউরেনিয়ামের নতুন দু’টি পরমাণুকে ভেঙ্গে প্রচুর তাপশক্তি উৎপন্ন করে চারটি নিউট্রনকে মুক্ত করে দেবে।
এইভাবে চলতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর অস্তিত্ব থাকবে। এই ধরণের রাসায়নিক বিক্রিয়াকে বলা হয় শৃঙ্খল বিক্রিয়া। চেইন রিয়েকশনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে তাপশক্তি বৃদ্ধি পেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। যেমন নিউক্লিয়ার বোমা। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুল্লীতে (Reactor) ইউরেনিয়ামের রডগুলো বিশেষভাবে সজ্জিত থাকে। চুল্লীগুলো বিভিন্ন ধাপে খুব শক্ত ও প্রশস্ত কংক্রিট দিয়ে তৈরি করা হয় যাতে তেজস্ক্রিয়তা বাহিরে আসতে না পারে। ফিশনের পরিমাণ তথা চেইন রিয়েকশনকে নিয়ন্ত্রণের জন্য Cadmium দিয়ে নির্মিত নিয়ন্ত্রক রড/পাইপ ব্যবহার করা হয়। কারণ Cadmium মুক্ত নিউট্রনকে সহজেই চুষে নেয়। চুল্লীর তাপমাত্রাকে কমাতে বা একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় ধরে রাখতে নিয়ন্ত্রক পাইপ দিয়ে ইউরোনিয়াম রডকে ঢেকে দেওয়া হয়। আর সম্পূর্ণ রিয়েক্টরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহার করা হয় পানি। রিয়েক্টরের তাপে এই পানি বাষ্পে পরিণত হয়। এই বাষ্প দিয়েই টারবাইনের সাহায্যে জেনারেটর চালিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। টারবাইনে ব্যবহারের পর এই বাষ্পকে কুলিং টাওয়ারের মাধ্যমে পানিতে পরিণত করে আবার রিয়েক্টরে ফেরত পাঠানো হয়। প্রয়োজনে অতিরিক্ত বাষ্প চিমনি দিয়ে বের করে দেওয়া হয় ও নতুন পানি বাহির থেকে সরবরাহ করা হয়। চুল্লীর মধ্যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় যেসব তেজস্ক্রিয় পার্টিকেল প্রস্তুত হয় তারমধ্যে Deuterium ও tritium অন্যতম। এগুলো পানির হাইড্রোজেন পরমাণুর সাথে নিউট্রন যুক্ত হয়ে সৃষ্টি হয়।
কোন কারণে রিয়েক্টর বন্ধ করে দিলেও কয়েকদিন পর্যন্ত রিয়েক্টরের ভেতর উচ্চ তাপমাত্রা থাকে। কারণ পারমাণবিক বিক্রিয়া হঠাৎ করে সম্পূর্ণ থামিয়ে দেয়া যায় না। তাই রিয়েক্টর বন্ধ করে দিলেও ডিজেল জেনারেটর অথবা ব্যক আপ জেনারেটর দিয়ে পাম্প চালিয়ে রিয়েক্টরে পানির প্রবাহ সচল রাখা হয়। ডিজেল জেনারেটর কাজ না করলে ব্যাটারি ব্যাবহার করে পাম্প সচল রাখারও ব্যবস্থা আছে। এই পানির প্রবাহ যদি কোন ভাবে বন্ধ হয়ে যায়, তবে রিয়েক্টরের তাপমাত্রা কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, ফলে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটবে। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক কালে (18 March, 2011) জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক চুল্লি একই সাথে প্রচন্ড ভূমিকম্প ও সুনামির আঘাতে মারাত্নকভাবে ক্ষতিগ্রস্থের কারণে বিকল্প পাম্পগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চুল্লিতে পানি সরবরাহ সচল রাখা সম্ভব হয়নি। যার ফলে অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে বিস্ফোরণ ঘটে।
পানির ব্যবহারের তারতম্যের উপর ভিত্তি করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে দুইভাগে ভাগ করা যায়: Pressurized Water Reactor ও Boiling Water Reactor।
১) Pressurized Water Reactor (PWR):
এখানে পানিকে বিশেষভাবে চাপের মধ্যে রাখা হয়, ফলে পানি খুবই গরম হবে কিন্তু ফুটবে না বা বাষ্পে পরিণত হবে না। এই super heat পানিকে একটি তাপ পরিবাহী পাইপের মধ্যে দিয়ে চালনা করা হয়। পাইপটির অংশ বিশেষ স্টীম জেনারেটর বা হিট চেইঞ্জারের মধ্যে প্রবেশ করনো থাকে। বাহির থেকে সরবরাহকৃত পানি স্টীম জেনারেটরে এসে সুপার হিট পানির তাপ শোষন করে বাষ্পে পরিণত হয়। এই বাষ্প টারবাইনকে সচল করে কনডেনসর/কুলিং টাওয়ারে এসে পানিতে পরিণত হয়ে আবার চুল্লীতে একই প্রক্রিয়ায় ফিরে যায়। সুবিধা: চুল্লীর তেজস্ক্রিয় পানি বাহিরে আসতে পারে না। অসুবিধা: পানিকে চাপে রাখার জন্য আলাদা শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন হয়। জাপানের ফুকুশিমায় বিপর্যস্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ছিল এধরনের Pressurized Water Reactor।
২) Boiling Water Reactor (BWR):
এখানে চুল্লীতে চেইন রিয়েকশনের তাপে পানি সরাসরি বাষ্পে পরিণত হয়। এই তেজস্ক্রিয় বাষ্প চুল্লীর বাহিরে এসে টারবাইনকে সচল করে কনডেনসর/কুলিং টাওয়ারে পানিতে পরিণত হয়ে আবার চুল্লীতে ফিরে যায়। অসুবিধা: চুল্লীর তেজস্ক্রিয় পানি বাহিরে আসায় সহজে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। সুবিধা: পানিকে চাপে রাখার জন্য আলাদা শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না।
মেল্টডাউন: রিয়েক্টরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে ফুয়েল রড তথা ইউরেনিয়াম রড গুলো গলে গিয়ে রিয়েক্টরের মেঝেতে তেজস্ক্রিয় জ্বালানী ছড়িয়ে পড়তে পারে। রিয়েক্টরের মেঝে ২২০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা পর্যন্ত সহ্য করতে পারে। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত পারমাণবিক বিক্রিয়ার (চেইন রিয়েকশন) ফলে তাপমাত্রা ৪০০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যেতে পারে। ফলে রিয়েক্টরের মেঝে গলে গিয়ে তেজস্ক্রিয় পদার্থ মাটির নীচে চলে যাবে এবং ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহের সাথে মিশে যাবে। দৈনন্দিন ব্যবহার্য পানি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মাটির নীচ থেকে সংগ্রহ করা হয়, সেক্ষেত্রে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া রিয়েক্টরের তেজস্ক্রিয় বাষ্প বাতাসের অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের সংস্পর্শে এসে বিস্ফোরণ ঘটায়।
একটি পারমাণবিক শক্তির চুল্লি স্থাপনের পূর্বে অঞ্চলের পরিবেশ, ভূ-কম্পন প্রবনতা, হাইড্রোলজি, আবহাওয়াবিদ্যা, জনসংখ্যা এবং শিল্প-পরিবহন ও সামরিক স্থাপনাসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে হয়। এছাড়া অগ্নিকান্ড, বিস্ফোরণ, বিকিরণ, ও দুর্ঘটনার কারণে মহাবিপর্যয় ঘটতে পারে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণে আন্তর্জাতিক মানের নিউক্লিয়ার বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন। পারমাণবিক বিদ্যুৎ চুল্লির দুর্ঘটনার ফলে ক্যান্সারজনিত রোগের সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। যেসব স্থানে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে সেসব স্থানে জন্ম নেয়া সকল শিশুই শারীরিক প্রতিবন্ধীকতার শিকার হয়, জমির উর্বরতা চিরদিনের জন্য বিনষ্ট হয়। পারমাণবিক চুল্লিতে রাসায়নিক বিক্রিয়ার পর সৃষ্টি হয় তেজস্ক্রিয় বর্জ্য যা জীবজগত ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক বিপদজনক। এসব বর্জ্য কমপক্ষে ১০,০০০ বছর বিশেষভাবে সংরক্ষণ করতে হয় যেন তেজস্ক্রিয়তা ছড়াতে না পারে। যতই নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হউক না কেন তারপরেও প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও কারিগরি ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কমবেশি থেকে যায়। কোন দেশ বা জাতিকে বিপন্ন করার জন্য আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীরা সে দেশের পারমাণবিক চুল্লিতে হামলা চালাতে পারে। এছাড়া পারমাণবিক চুল্লির প্রযুক্তি ও ইউরেনিয়াম দিয়ে পারমাণবিক মারণাস্ত্র তৈরির সম্ভাবনা থাকে। পারমাণবিক চুল্লির শক্তির উৎস হচ্ছে অপ্রতুল ও দুর্লভ মৌল ইউরেনিয়াম। বিজ্ঞানীদের ধারণা বর্তমানে যে হারে ব্যবহার হচ্ছে তাতে আগামী ৪০ থেকে ৬০ বৎসর পর ইউরেনিয়াম আর পাওয়া যাবে না। পারমাণবিক চুল্লি নির্মান খুবই ব্যয়বহুল ব্যাপার।
বিশ্বের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১৬% আসে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। বিশ্বের ৩১টি দেশের ৪৪০টি পারমাণবিক চুল্লিতে এই বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের একাই রয়েছে ১০৪টি রিয়েক্টর যেখানে উৎপাদন হয় তাদের ২০% বিদ্যুৎ। ফ্রান্সের ৫৯টি রিয়েক্টর সেদেশের মোট উৎপাদনের ৭৮% বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। বর্তমানে যেসব দেশে আরো রিয়েক্টর নির্র্মানাধীন রয়েছে তারমধ্যে শীর্ষে রয়েছে চীন ও ভারত। ভারতে বর্তমানে ২০টি পরমাণু চুল্লি রয়েছে। যারা একটি বাদে সব ক'টি চালু রয়েছে। বর্তমানে ভারতের মাত্র ৩ শতাংশ চাহিদা মেটে পরমাণু বিদু্ৎতে। এই উৎপাদন ২০২০ সালের মধ্যে বাড়িয়ে ৬ শতাংশ ও ২০৩০ সালে ১৩ শতাংশ করার পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের।
International Nuclear and Radiological Event Scale (INES): পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুর্ঘটনার কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি ও সম্ভাব্য বিপর্যয়কে পরিমাপ করার জন্য যে স্কেল ব্যবহার হয় তাকে সংক্ষেপে INES স্কেল বলা হয়। এর প্রণেতা হচ্ছে International Atomic Energy Agency (IAEA)।
ক্ষয়ক্ষতি ও বিপদমাত্রার পরিমানকে এই স্কেলে সাত ভাগে ভাগ করা হয়েছে। স্কেলের ধাপগুলোকে লগারিদম পদ্ধতিতে বাড়ানো হয়েছে, অর্থাৎ ক্ষয়ক্ষতি ও বিপদমাত্রার পরিমান প্রতি ধাপে দশ গুণ করে বাড়ে। উল্লেখ্য ১৯৮৬ সালের ইউক্রেনে চেরনোবিল দুর্ঘটনাকে স্কেলের সর্বোচ্চ ৭ নম্বর মহা বিপর্যয়, ১৯৫৭ সালে রাশিয়ায় মায়াক দুর্ঘটনাকে ৬ নম্বর বিপর্যয়, সাম্প্রতিক কালে জাপানের ফুকোশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুর্ঘটনাকে ৫ নম্বর বিপর্যয় এবং ১৯৮০ সালে ফ্রান্সের সেন্ট লরেন্ট দূর্ঘটনাকে ৪ নম্বর পর্যায়ের বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
তারপর ও কেন আমরা পারমানবিক বিদ্যুৎ কে স্বাগত জানাবঃ
প্রযুক্তিকে সঠিক সময় গ্রহন না করে পিছিয়ে পড়াটা বর্তমানে আত্মহত্যার-ই সামিল। তুরস্কের এত বৃহৎ অটোম্যান সম্রাজ্য ভেঙ্গে খান-খান হওয়ার পেছনের অন্যতম কারন ছিল তৎকালীন নব্য প্রযুক্তি গ্রহনের উন্ন্যাসিকতা। যাই হোক,বিদ্যুৎ শক্তির অভাব বর্তমানে প্রকট আকার ধারন করেছে। আমাদের বিদ্যুৎ শক্তির প্রধান উৎস প্রাকৃতিক গ্যাস, যার অধিকাংশই নব্য সম্রাজ্যবাদী কিছু কম্পানীর কাছে দায়বদ্ধ (কারন বাপেক্সকে সুপরিকল্পিত ভাবে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে)। গ্যাসের হিটিং ভ্যালু কম হওয়ায় এটা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গ্যাসের সবচেয়ে ইনএফিসিয়েন্ট কাজগুলির মধ্যে অন্যতম। আর গ্যাস বিভিন্ন সার প্রস্তুতির কাঁচামাল, গ্যাস শেষ হয়ে যাওয়া মানেই সারের দাম তথা চাউল সহ শস্যের দাম আরও কি পরিমান বাড়বে, সেটা কল্পনা করতেও ভয় হচ্ছে। তাই আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিকল্প ব্যাবস্থা নেয়া উচিত। বায়োডিজেল সম্পুর্ণ সমাধান নয়, কারন এতে বর্ধনশীল ফসল বা ডিজেলের কাঁচামাল উৎপাদনের জন্য জেনেটিক্যালি মডিফায়েড বীজ বা জেনম ব্যবহৃত করা হয় যা উক্ত জমিকে সম্পুর্ণরূপে উর্বরতাশুণ্য করে দেবে যা হবে এই ধরিত্রী ও মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে জিঘাংসামূলক কাজের মধ্যে একটি, যার কাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে ব্রাজিলে শুরু করে দিয়েছে। সৌরবিদ্যুৎ খুবই ব্যয়বহুল ও আমাদের মতন বর্ধিষ্ণু কিন্তু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অপর্যাপ্ত। তাই এখন সবদিক বিবেচনা করে একটি এফিসিয়েন্ট পথ খোলা আছে আর তা হল পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন। প্রশ্ন উঠতে পারে এটাতো অনেক ব্যয়বহুল, একদম ঠিক; কিন্তু বাজারে গিয়ে একটু বেশী খরচ করেও কেন ভালো জিনিসটা কিনি? কেন সস্তায় সেলেরন না কিনে একটু বেশী খরচ করে হলেও ইন্টেলের প্রসেসর কিনি? উত্তরটা আমরা সবাই জানি, তাই না। সরকার বায়ুসেনাদের জন্য শত হাজার কোটি টাকা খরচ করে জাতীয় দিবসের প্যারেড গ্রাউন্ডের ওপর দিয়ে বিমানের ডগ-ফাইট দেখার জন্য যদি মিগ-২৯ বিমান কিনতে পারেন তবে একটি প্রয়োজনীয় সেক্টরে টাকা বিনিয়োগে সমস্যা কোথায়? তাই এই বৃহৎ জনগোষ্ঠির কাছে তৃণমূল পর্যায়ে বিদ্যুৎ পৌছে দেয়ার জন্য পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প দ্রুত গ্রহন করা অতি জরুরী, কারন ডিসিশান নেবার পর থেকে প্ল্যান্টের ফিজিবিলিটি টেস্ট, প্রসেস লাইসেন্সিং, ভ্যান্ডরদের মেশিনারীজ সাপ্লাই ও কমিশনিং-স্টার্টআপ করতেই ৩-৪ বছর লেগে যায়। এছাড়া দেশের ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশানের জন্য কোন ভোল্টেজ ফ্ল্যাকচুয়েশান ছাড়া আনইন্টারাপ্টেড বিদ্যুতের সরবরাহ করার জন্য পারমানবিক শক্তি অপরিহার্য। এপ্রসঙ্গে বলা যেতে পারে উন্নত বিশ্বের কিছু দেশ যাদের জনসংখ্যা খুবই কম, তাদের বৈভব আমাদের দেশের মতন নয়। তাদের দেশে জনসংখ্যার তুলনায় প্রচুর পরিমানে প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে যা বাংলাদেশে অনুপস্থিত। তাই আমাদের এই সম্পদকে অপ্টিমাইজ ওয়েতে কাজে লাগাতে হবে। তাই তাদের পারমানবিক প্রযুক্তি গ্রহন করে বিদ্যুৎ উৎপাদন অত্যাবশ্যকীয় নয়, যতটা না আমাদের।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, আমরা কি এত বৃহৎ ও রিস্কি প্ল্যান্ট চালাতে পারব? আমি স্বরণ করিয়ে দিতে চাই আমাদের ছেলেরাই বিদেশে গিয়ে রিসার্চ ও ইঞ্জিনিয়ারিং-এ যে সাফল্য দেখায় তা কি আমরা জানিনা? জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতি এতটাই অনাস্থাপূর্ণ আমরা? ইন্টেলের বাংলাদেশী প্রকৌশলীদের দ্বারা প্রস্তুতকৃত প্রসেসর নিজের পিসিতে ব্যবহার করেও আমরা নিজেদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলি? দুঃখজনক। আমাদের দেশে প্রচুর ভালো ভালো প্রকৌশলী আছে আমাদের দৃষ্টির আবডালে (যেমনঃ জামিলুর রেজা স্যার -যমুনা সেতুর ডিজাইনে ওনার অবদানের কথা প্রায় সবাই জানি)। কেউ যদি দেশের কোন সার কারখানা ভ্রমন করেন তাহলে আমাদের প্রকৌশলীদের দক্ষতা সম্পর্কে কোন সন্দেহ থাকবেনা, কিন্তু সরকারের উচিত হবে তাদের দেশের জন্য কাজ করার উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরী করে দেয়া যাতে তারা বিদেশমুখী না হয়।
তৃতীয় প্রশ্ন, পারমানবিক বর্জ্যের কি হবে? সেটার জন্য কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা রয়েছে যারা পারমানবিক বর্জ্য ট্রিটমেন্ট করে। আবার এটাও আশঙ্কা করা স্বাভাবিক, চেরনবিলের মতন দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কতটুকু? আসলে, প্রযুক্তি এই গত দু'দশকে অনেক এগিয়েছে, এখন ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়ামের ফুয়েল রডের স্থলে পিবল বেড রিয়াক্টর ব্যবহার করা হয় যা একশত ভাগ নিরাপদ। আমরা তো আর নিউক্লিয় জ্বালানী পরিশোধন বা উৎপাদনের কোন কৌশল হস্তগত করতে চাচ্ছিনা, আর বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে জ্বালানী ব্যবহৃত হয় তা দিয়ে কোন ভাবেই উইপনস গ্রেডের জ্বালানী প্রস্তুত সম্ভব নয়, তাই এদিক থেকে আমরা সম্পুর্ণ নিরাপদ।দেশের তেল-গ্যাস ও কয়লা সম্পদ বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র অবলম্বন হল আমাদের বিকল্প শক্তি তথা নিউক্লিয়ার এনার্জির দিকে ঝুকতেই হবে, আজ অথবা কাল। তাই দেরী করার কোন মানেই হয়না। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে আমি রাশান প্রযুক্তির বিরোধী। মার্কিন বা ইউরোপীয় প্রযুক্তি অপেক্ষাকৃত দামী হলেও নির্ভর যোগ্য। নিদেনপক্ষে কোরিয়ান বা জাপানিজ প্রযুক্তি গ্রহণ করাটা উচিৎ ছিলো। এবার আসি মূল
প্রসঙ্গে, 'জার্মানী কিন্তু এরই মধ্যেই নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কমানো শুরু করেছে,কেন?'
ধনী দেশ গুলোর উদাহরন সম্পর্কে বলার আর কিছুই নেই। কারন ওরা নিজেদের আখের অনেক আগেই গুছিয়ে নিয়েছে। তাই জার্মানী ও অন্যন্য ধনি দেশগুলোর উদাহরন বাংলাদেশের জন্য কতখানি প্রযোজ্য হবে সেটি ভেবে দেখার বিষয়। গ্লোবাল ওয়ার্মিং বাংলাদেশের শুধু নয় সমস্ত বিশ্বের সমস্যা, কিন্তু এতে বাংলাদেশের কন্ট্রিবিউশান দশমিকের পরে তিন-চারটা শুণ্য দিলে যা হবে % তত ভাগও নয়। এযেন পরের পাপে নিজের শাস্তি।। তাই বাংলাদেশ তার দেশের উন্নতির জন্য যদি একটু পরিবেশ দুষন করে, তবে সেটা বৈশ্বিক ভাবে ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না, কারন যা ক্ষতি করার যুক্তরাষ্ট্র করে এখন সে অরন্যের রোদনে দরিদ্র দেশগুলোকে আমেরিকার মধু পিয়াসী বিশ্বব্যঙ্ক ও আই.এম.এফ-দের দিয়ে পরিবেশ সচেতন করানোর মহান তালিমে নেমেছেন, কিন্তু নিজেই কিওটো প্রটোকল মানছে না। মানুষ হিসেবে আমাদের প্রধান লক্ষ্য এ বিপর্যয়ের হাত থেকে বিশ্বকে উদ্ধার করা, কিন্তু বাংলাদেশী হিসেবে আমি মনে করি, পরিবেশের সর্বনিম্ন ক্ষতি করে হলেও আমাদের উন্নয়নের পথ ধরা উচিত।
কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ পড়ে প্রায় ০.৬ থেকে ১.৬ সেন্ট প্রতি কিলোওয়াট ঘন্টায় যেখানে প্রাকৃতিক গ্যাসে খরচ পড়ে প্রায় ০.০৭ থেকে ১.১ সেন্ট প্রতি কিলোওয়াট ঘন্টায় এবং জ্বালানী তৈল থেকে ১.২ সেন্ট।
এবার নবায়ন যোগ্য শক্তির প্রসঙ্গে আসা যাক, সৌর শক্তির মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুতের খরচ প্রায় ৫০ থেকে ৮০ সেন্ট প্রতি কিলোওয়াট ঘন্টায় আর বায়ু শক্তির মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুতের খরচ প্রায় ৫.৫ থেকে ১৩ সেন্ট প্রতি কিলোওয়াট ঘন্টায়, কিন্তু আমাদের দেশের একমাত্র কিছু উপকূলীয় এবং দ্বীপাঞ্চল ছাড়া বায়ু শক্তি কাজে লাগানোটা দুস্কর, তার ওপর এই উপকূলে ঝড়-ঝঞ্ঝার পরিমান বেশী হবার দরূন সব উপকূলীয় এলাকায় এগুলো স্থাপন করাটাও কতটুকু সমীচীন সেটা বিবেচনায় আনাটা জরুরী। কিন্তু নিউক্লীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুত উৎপাদন খরচ বেশ কম, আর তা মাত্র ০.২৫ থেকে ০.৬ সেন্ট প্রতি কিলোওয়াট ঘন্টায়। এখানে আরেকটি কথা উল্লেখ না করলেই নয় যে রাশিয়া সারা বিশ্বে ৪০% ইউরেনিয়াম রপ্তানী করে থাকে সেখানে আমাদের দেশ নিজেদের অর্থায়নে ঋনের মাধ্যমে পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে দেবার সাথে সাথে তার নতুন এক ক্রেতাও পাচ্ছে , বলা যায় এক ঢিলে দুই পাখি ।
o আমাদের মত জনবহুল দেশে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট বসানোর মত লোকেশন আদৌ আছে কি? এর সামান্য একটা একসিডেন্টের ফলাফল কি হতে পারে?
এখানে দেখুন, ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ক্যাজুয়ালিটির হার দেয়া আছে, যেখানে স্পশটতই দেখা যাচ্ছে নিউক্লিয়ার টেকনোলজি কতটা নিরাপদ। জাপানের ফুকুশিমার ঘটনাটি অনভিপ্রেত।
o প্ল্যান্টের অর্থায়ন, প্ল্যান্ট বসানো ও মেইনটেইনেন্সের টেকনিক্যল এক্সপার্টিজ এবং জ্বালানি- তিনটার কোনটারই আমাদের হাতে নেই- মানে আমরা পুরোটাই বাইরের প্রভু রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল। ফলাফল কি?
আচ্ছা, গ্যাস প্ল্যান্ট যেগুলো আমাদের দেশে আছে, এগুলো কি আমাদের দেশের অর্থায়নে বা ডিজাইনে তৈরী? সবগুলোই প্রভূ রাষ্ট্রের কারিগরী সহায়তায় তৈরী। এপর্যন্ত জ্বালানীর অভাবে কোন রিয়েক্টর শাট-ডাউন হয়েছে বলে শুনেছেন (ইরানের কথা বাদ দেন, ওইটা ভিন্ন কেইস) আর বিদ্যুৎ উৎপাদনের ইউরেনিয়াম এর গ্রেড আর উইপন্স গ্রেড এক না, এইটা সবাই জানে। বিশ্বের ৩০ টি দেশে ৪৩৭ টি পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনা আছে, আর ৫০ টি নির্মানাধিন।
o এমন হাইলি টেকনিক্যল ও সফিসটিকেটেড প্রযুক্তি আনার মত টেকনিক্যল এক্সপার্টিজ আমাদের আছে?
হাইলি সফিসটিকেটেড টেকনলজির ব্যপারটা বোধগম্য নয়! নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর থেকে শুধু আমরা শক্তি পাব, বাকি পুরোটাই কনভেনশনাল বয়লারে পানি গরম করে স্টিম বানিয়ে টার্বাইন ঘোড়ানো। প্রায় সত্তর-আশি বৎসর আগের একটা প্রযুক্তিকে আপনি হাইলি সফিসটিকেটেড বলতে পারেন না এখন আর। বর্তমানে প্রযুক্তি অনেক এগিয়েছে। জার্মানি-যুক্তরাষ্ট্র-জাপান যে সকল পারমানবিক চুল্লি বন্ধ করে দিচ্ছে, সেগুলো পুরাতন প্রযুক্তির। নিউ জেনারেশন নিউক্লিয়ার রিয়াক্টর গুলো ১০০% নিরাপদ আর প্ল্যান্ট লাইফ ৭০ বৎসর! তার মানে পুরো এক প্রজন্মের বিদ্যুৎ নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না। আর নিউ জেনারেশন নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর 'পিবল বেড' টাইপ। সেই প্রাচীন মান্ধাতা নিউক্লিয়ার ফুয়েল রড দিয়ে চেইন বিক্রিয়া করানো হয় না যার কারনে আরেকটা ফুকুশিমা, চেরনোবিল বা থ্রি মাইল আইল্যান্ডের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই বলা যায় এটি শতভাগ সেইফ।
কিন্তু আমি রাশিয়ান টেকনোলজি সম্পর্কে কিছু জানিনা। তারা এখনোও প্রাচীন পদ্ধতি ব্যবহার করে কিনা। ব্যক্তিগত ভাবে এজন্য আমি রাশান প্রযুক্তির বিরোধী, আর সরকার একটু সস্তা দেখে যদি তাদের প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকে পরে, তাহলে ব্যাপারটা ভালো হবে বলে মনে হয় না। এর চেয়ে জাপানী বা দক্ষিন কোরিয়ান প্রযুক্তি অনেক উন্নতমানের ও নির্ভরযোগ্য। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের ডিজাইন, কন্সট্রাকসন, কস্টিং সবকিছু সম্পর্কে ধারনা পেতে চাইলে এম.আই.টি -র একটা প্রসেস ডিজাইন অভিসন্দর্ভ 'নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট ডিজাইন ' দেখতে পারেন।
মূলত মার্কিন প্রভূরা জানেন যদি নিউক্লিয়ার শক্তি জনপ্রিয় হয় তাহলে তাদের তেলের রাজনীতি বন্ধ হয়ে যাবে আর তাদের একচ্ছত্র আধিপত্ত থাকবেনা। ঠিক এই কারনেই তারা নিউক্লিয়ার শক্তির বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাতে পটু। এ নিয়ে হলিউডে কিছু ফিল্ম-ও বানানো হয়েছে। কিন্তু আশা রাখি, অতি সত্বর সরকার নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যাপারে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেবেন আর আমরা লোডশেডিং এর কবল থেকে রক্ষা পাব।
তর্ক-বিতর্ক থাকবেই, কিন্তু এর মধ্যে থেকেই এগিয়ে যেতে হবে, কারন সামনেই আছে সোনালী ভবিষ্যত। কিন্তু রূপপুরের পরমাণু প্রকল্পের মতন কোন অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে যেন এ উদ্যোগ -ও যেন ব্যর্থ হয়ে না যায় সেদিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত।
রেফারেন্সঃ zero2inf.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন