কওমি মাদরাসা নিয়ে একটি প্রবন্ধ
সংগ্রহিত প্রবন্ধ / নয়াদিগন্ত
কওমি মাদরাসা সম্পর্কে আমার কোনো স্বচ্ছ ধারণা নেই। আমি জানি না, এসব মাদরাসায় ঠিক কী পড়ানো হয়। এদের পাঠ্যসূচি কেমন? বাংলাদেশে নাকি এখন আছে ৮০ হাজারের ওপর কওমি মাদরাসা। অনেকে বলছেন, আইন করে এদের তুলে দিতে হবে; কেননা এদের মতে এসব মাদরাসাকে কেন্দ্র করে উদ্ভব হতে পারছে ইসলামি জঙ্গিবাদ (Militant Islam)। যতদূর জানি কওমি শব্দটি আরবি। কওম বলতে বোঝায় জাতি বা গোষ্ঠীকে। মাদরাসা শব্দটিও আরবি ভাষার। মাদরাসা বলতে আরবিতে বোঝায় উচ্চবিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সে দিক থেকে বিচার করলে বলতে হবে কওমি মাদরাসা হলো এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা বিদ্যানিকেতন, যেখানে ছাত্রদের শিক্ষা দেয়া হয় জাতীয়তাবোধ উদ্বোধনের জন্য। কওমি মাদরাসা হলো জাতীয়তাবাদভিত্তিক শিক্ষানিকেতন। মুসলমান না থাকলে আজকের বাংলাদেশ হতো না। মুসলমান জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে আছে ইসলামের স্বাতন্ত্র্য চেতনা। এই স্বাতন্ত্র্যবোধ হলো আজকের পৃথক স্বাধীন বাংলাদেশের নৈতিক ভিত্তি। বাঙালি হিন্দু কোনো দিন চায়নি একটি পৃথক স্বাধীন বাংলাদেশ গড়তে। তারা বিশ্বাস করেছে ভারতীয় জাতীয়তাবাদে। কিন্তু বাংলাভাষী মুসলমান তা করেনি। আর করেনি বলেই উদ্ভব হতে পেরেছে আজকের পৃথক স্বাধীন বাংলাদেশের। এটি আমাদের উপলব্ধিতে থাকা প্রয়োজন। ১৯৭১ সালে ভারত যুদ্ধ করেছিল পাকিস্তানের সাথে। তার লক্ষ্য ছিল সাবেক পাকিস্তানকে ভেঙে দিয়ে ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত করা। কিন্তু নানা কারণে তার সেই ইচ্ছা এখনো সাফল্য পেতে পারেনি। কিন্তু ভারত বাংলাদেশের ব্যাপারে এখনো অনুসরণ করছে তার সাবেক নীতি, যাকে আমরা বলি স্বাধীনতাযুদ্ধ, ভারত তাকে দ্যাখে পাক-ভারত যুদ্ধ হিসেবে। আর এ কারণে বর্তমান পাকিস্তানের সাথে ১৯৭২ সালে সিমলা চুক্তি করার সময় ডাকা হয়নি বাংলাদেশকে।
আমরা আলোচনা করছিলাম কওমি মাদরাসা নিয়ে। শুনতে পাই, কওমি মাদরাসায় নাকি কেবলই কুরআন-হাদিস চর্চা করা হয়। তবে তা থেকে মানবজীবন সম্পর্কে গড়ে উঠতে পারে একটি ব্যাপক ধারণা। কওমি মাদরাসার ছাত্ররা কুরআন-হাদিসের চর্চার ক্ষেত্রে এরকম ব্যাপক ধারণার অধিকারী হতে পারছে কি না, আমরা তা জানি না। তাই বলতে পারি না, কওমি মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে। তবে এটুকু বলতে পারি, কওমি মাদরাসার ছাত্ররা করছে না চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি। কওমি মাদরাসায় ভর্তি হতে পারে যেকোনো ছাত্র। এর জন্য তাদের মুখাপেক্ষী হতে হয় না কোনো কোচিং সেন্টারের। কওমি মাদরাসায় পড়তে কোনো বেতন দিতে হয় না। ছাত্ররা কওমি মাদরাসায় পেয়ে থাকে খাওয়া-পরার জন্য সহায়তা। কওমি মাদরাসায় পড়ে এ দেশের হতদরিদ্র পিতামাতার সন্তান। কওমি মাদরাসার ছাত্ররা কোনো চাকরি পাওয়ার লক্ষ্যে পড়াশোনা করে না। তারা সৃষ্টি করছে না শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। তারা হারাচ্ছে না এই কৃষিজীবী দেশের অর্থনীতির সাথে যোগাযোগ। হারাচ্ছে না কৃষি কাজের দক্ষতা। এ দিক থেকে দেখলে বলতে হবে, কওমি মাদরাসার ছাত্ররা থাকছে এ দেশের সনাতন অর্থনীতির সাথে সংলগ্ন। তারা চাচ্ছে না লেখাপড়া শিখে ফ্যানের হাওয়ার নিচে বসে অফিসে চাকরি করতে।
শিক্ষার লক্ষ্য যদি হয় নৈতিক মানুষ গড়া, তবে সম্ভবত কওমি মাদরাসার ছাত্ররা সেটি যথেষ্ট পাচ্ছে। তারা হচ্ছে না চোর-ডাকাত। হচ্ছে না মাদকাসক্ত।
মুসলিম বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায়, এতে ছিল এবং এখনো আছে তিন স্তরের শিক্ষাব্যবস্থা। প্রাথমিক স্তরকে বলা হয় মক্তব। মাদরাসা বলতে বোঝায় উচ্চতর শিক্ষানিকেতন। সর্বোচ্চ শিক্ষানিকেতনকে বলা হয় দারুল উলুম। একসময় মক্তব, মাদরাসা ও দারুল উলুমে কেবল ধর্ম বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হতো না। শিক্ষা দেয়া হতো বিভিন্ন বিষয়ে। এই শিক্ষাব্যবস্থার বিচার-বিশ্লেষণ হতে পারে আমাদের জন্য শিক্ষাব্যবস্থার প্রকর্ষ সাধনে যথেষ্ট সহায়ক। কিন্তু সেটি আমরা করতে চাচ্ছি না। অনেকে মনে করেন, ধর্ম মানুষকে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন করতে চায়। কিন্তু পৃথিবীর নানা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, ধর্মকে ঘিরে গড়ে উঠছে শিক্ষাদান কেন্দ্র। বিলাতের বিখ্যাত অক্সফোর্ড (১১১৫) ও ক্যামব্রিজ (১২০৯) বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল ধর্মযাজকদেরই দিয়ে। জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চায় এ দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে খ্যাতি এখন জগৎজোড়া। এ দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অজ্ঞতা ও কুসংস্কারে জড়িয়ে পড়েনি। ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি যে, মুর মুসলমানেরা স্পেন জয় করে সেখানে গড়ে তোলেন একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় বা দারুল উলুম। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল করদোবা বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে কেবল মুসলমান ছাত্ররাই পড়ত না, পড়ত খ্রিষ্টান ছাত্ররাও। করদোবার খ্রিষ্টান ছাত্রদের মধ্যে একজন ছিলেন গার্বাট (Gerbert)। গার্বাট পরে হন পোপ সিলভেস্টার দুই (Pope Silvester 2)। গার্বাট গণিতে ছিলেন খুব ভালো। তিনি করদোবা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রহণ করেন গণিতের শিক্ষা। তিনি ইতালিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় করেন আরবি সংখ্যা লিখনপদ্ধতির প্রবর্তন। গণিতকে ঘিরে ইউরোপে হতে থাকে বিজ্ঞানের বিকাশ। আমরা যখন আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করি, তখন দেখি মুঘল আমলে বাংলা ও উত্তর বিহারজুড়ে এক লাখের ওপর বিদ্যালয় ছিল। যেসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যম ছিল ফারসি ভাষা; বাংলা বা হিন্দি ভাষা নয়। এই শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বের সূচনায় একটি রিপোর্ট রচনা করেন ব্রিটিশ খ্রিষ্টান মিশনারি উইলিয়াম অ্যাডাম (W Adam; ১৮৩৫-১৮৩৮) নাটোরে বসে; যা থেকে বোঝা যায়, মুঘল আমলে ইংরেজ আমলের চেয়ে অনেক বেশি লোক পড়তে, লিখতে ও গুনতে জানত। ইংরেজ আমলের একপর্যায়ে তখনকার সারা ভারতে শিক্ষিতের হার দাঁড়ায় পাঁচ শতাংশ মাত্র। শিক্ষিত বলতে বোঝায় যারা নিজের নাম সই করতে পারে। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক এইচ ডি রাওলিনসন মুঘল শাসনামলের সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, মানুষ এ সময় জ্ঞানচর্চাকে মনে করত ধর্মীয় কর্তব্যেরই অঙ্গ। ইউরোপে ছাত্ররা যখন গ্রিক ও লাতিন ভাষার মাধ্যমে জ্ঞানচর্চা করেছে, তখন ভারতে মুসলমান ছাত্ররা জ্ঞানচর্চা করেছে আরবি ও ফারসি ভাষার মাধ্যমে। (India- A short Cultural History; H. D. Rawlinson)।
বাংলাদেশে ১৮৩৮ সাল পর্যন্ত ফারসি ছিল আদালতের ভাষা। ফারসিতে লেখা হতো দলিল-দস্তাবেজ। রাখা হতো ভূসম্পত্তি সম্পর্কিত হিসাব-নিকাশ। আদালত থেকে ফারসি ভাষা উঠে যাওয়ার ফলে মুসলমানেরা পিছিয়ে পড়েন চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে। ইংরেজি শিখে চাকরিজীবী নতুন মধ্যবিত্ত সমাজের উদয় হতে লেগে যায় অনেক সময়। ইংরেজ আমলে কলকাতা শহর হয়ে ওঠে সারা ভারতের রাজধানী। হয়ে ওঠে শিক্ষা সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। কলকাতা ও তার সংলগ্ন অঞ্চল ছিল হিন্দুপ্রধান। ভৌগোলিক কারণে বাংলার মুসলমান পাশ্চাত্য শিক্ষায় সেভাবে শিক্ষিত হতে পারেন না। ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ (১৮৭১-১৯১৫) চান ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করতে। তিনি এর জন্য ঢাকায় জমিও দান করেন। তার মৃত্যুর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালের জুলাই মাসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর হন পি জি হার্টগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ার আগে তিনি ছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক রেজিস্ট্রার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তোলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে পূর্ববঙ্গের মুসলমান সমাজে একটি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব সম্ভব হয়েছিল।
বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলাম তৎপর হয়ে উঠেছে। হেফাজতী সংশ্লিষ্টরা গড়েছেন কওমি মাদরাসা। কিন্তু তারা বলছেন না দেশে কেবল কওমি মাদরাসা রেখে আর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশের বাম বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, কওমি মাদরাসা তুলে দিতে হবে; কারণ তাদের মতে কওমি মাদরাসায় জন্ম নিচ্ছে ইসলামি জঙ্গিবাদ। তাদের এ অভিযোগ এখনো প্রমাণিত হতে পারেনি। কওমি মাদরাসা বন্ধ করতে গেলে মনে হয় দেশে দেখা দেবে আরো বড় রকমের রাজনৈতিক জটিলতা। কওমি মাদরাসা বন্ধের দাবিকে তাই সাধারণভাবে সমর্থন দেয়া যায় না। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্ররা নানা রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। কওমি মাদরাসার ছাত্ররাও ঠিক একইভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনে নিতে পারে অংশ। কিন্তু আমরা অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে তুলে দেয়ার কথা ভাবছি না। ভাবছি কেবল কওমি মাদরাসা তুলে দেয়ার কথা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন